আজ সেই ভয়াল ও বীভৎস ২৫শে মার্চ।
- National Genocide Day. 25th March.
- Mar 25, 2017
- 3 min read
গণহত্যা দিবসে সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা.............

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এমন ভয়ানক রাত আগে কখনো আসেনি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত। শুরু হলো বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এক পরিকল্পিত সামরিক অভিযান, যার নাম অপারেশন সার্চলাইট। একই সঙ্গে সূচনা হয় বাঙালির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ। অপারেশন সার্চলাইটকে নিছক বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের একটি সামরিক চেষ্টা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল এক ভয়াল গণহত্যার নীলনকশা, গোপনে গোপনে যার প্রস্তুতি চলছিল অনেক আগে থেকেই। পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের মনে বাঙালিরা সব সময়ই ছিল নীচু শ্রেণির, যাঁদের ভাষা-সংস্কৃতি থেকে জীবনাচরণ—সবই ছিল ‘অপাকিস্তানি’। অখণ্ড পাকিস্তানের নামে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী সেই অপাকিস্তানিদের ‘শুদ্ধ’ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট শুরু করেছিল। যার ফলে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয় বাংলাদেশে।
অপারেশন সার্চলাইটের সিদ্ধান্ত হয়েছিল বেশ আগেই, একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত সাংবাদিক রবার্ট পেইনের ম্যাসাকার বইতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের খতম করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সেনা বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘ওদের ৩০ লাখ মেরে ফেলো। বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খেয়ে বেঁচে থাকবে (কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস)।’ এত ভয়াবহ ও গণবিধ্বংসী গণহত্যা খুব কম দেশেই হয়েছে। এত কম সময়ে এত বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়তো আর কোনো দেশে হয়নি। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় ইপিআর সদস্য বাঙালি জওয়ানেরা। এ অভিযানের আরও উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও, টেলিগ্রাফসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ধ্বংস করে দেওয়া, আওয়ামী লীগ এবং এর ছাত্রসংগঠনসহ সর্বোচ্চ সংখ্যায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা করা, ঢাকাকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা প্রভৃতি। এসব উদ্দেশ্য সফল করার জন্য পাকিস্তানিরা ওই রাতে মেশিনগানকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়। রবার্ট পেইনের মতে, অভিযানের প্রথম রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। এরপর গণহত্যা চলতে থাকে শহর পেরিয়ে গ্রামে।
অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম পর্যায় শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং একই সঙ্গে আক্রমণ চালানো হয় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেটে। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলা এ সামরিক অভিযান ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। দেশের এমন কোনো স্থান ছিল না, যেখানে বাঙালি নিধন করে পাকিস্তানি সেনারা লাশ নদীতে ভাসায়নি বা গণকবর দেয়নি। এর মধ্যে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে সম্ভবত সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে। একাত্তরের ২০ মে চুকনগরে এক দিনে প্রায় সাত থেকে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এ ছাড়া রংপুরের ঝাড়ুয়ার বিল, পাবনার ঈশ্বরদী, খুলনার প্লাটিনাম জুটমিল, গাইবান্ধার বোনারপাড়া, ঢাকার রায়েরবাজার ও মিরপুর, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অব্যাবহিত পূর্বে ঢাকার মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র পরিণত হয়েছিল বুদ্ধিজীবী নির্যাতন কেন্দ্রে। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে সেখানে নির্যাতন করত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী আলবদররা, আর পরে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হতো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে বাংলাদেশের গণহত্যাকে অন্যতম ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন সমাজবিজ্ঞানী আর জে রুমেল। তিনি তাঁর ডেথ বাই গভর্নমেন্টস বইতে লিখেছেন, ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী আধা সামরিক বাহিনীগুলো প্রতি ২৫ জন বাঙালির একজনকে হত্যা করেছে। যার সবচেয়ে কদর্য ও কুৎসিত চেহারা দেখা গেছে একাত্তরের ২৬৭ দিনে। নয় মাসব্যাপী গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের অর্ধেকই ছিলেন নারী। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য নারী পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী বাহিনীর সদস্যদের ধর্ষণের শিকার হন। গবেষক সুসান ব্রাউনমিলার অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন-উইমেন অ্যান্ড রেপ বইতে লিখেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আট বছরের শিশু থেকে ৭৫ বছরের বৃদ্ধাকে পর্যন্ত বর্বরভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।