বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খান,বাংলা ব্যান্ড জগতের মাইলফলক।
কিংবদন্তী পপগুরুর মৃত্যুবার্ষিকীতে সারেগামা বাংলা পরিবারের পক্ষ থেকে ঐকান্তিক শ্রদ্ধাঞ্জলি..
পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্ম নেয় শুধু সবাইকে সবকিছু দিয়ে যাওয়ার জন্য। বিনিময়ে মানুষের নামমাত্র ভালোবাসা ছাড়া জীবনে আর কিছুই পায়না। যারা অর্থ-বিত্ত আর ক্ষমতা পাওয়ার পেছনে ছুটে না। অর্থ বিত্তের কাছে নিজেকে বিক্রি করে না। খুব অল্পতেই সন্তুষ্টি থাকেন সবসময়। জীবনে সত্যিকারের এমন একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব এই দেশে খুব বিরল। লাখো মানুষে ভিড়ে এমন মানুষের দেখা পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যর। ঠিক তেমনই একজন বিরল মানুষ ছিলেন পপগুরু, পপসম্রাট নামে সবার কাছে পরিচিত একজন সত্যিকারের খাঁটি মুক্তিযুদ্ধা প্রিয় আজম খান । আজ তার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৫০ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে জন্ম নেন বাংলার এই পপ্ সম্রাট গুরু আজম খান যার পুরো নাম ছিল মাহবুবুল হক খান আজম। যিনি পরবর্তীতে আজম খান হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত ও প্রিয় হয়ে উঠেন। যার বড় ভাই এই দেশের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তী সুরকার আলম খান। ১৯৭১ সালে মাত্র ২০ পার করে ২১ বয়সের তরুণ আজম খান দেশকে স্বাধীন করতে ঘর থেকে বের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। ভারতে প্রশিক্ষন নিয়ে ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যেখানে তাঁর হাতের বন্দুক বেজেছিল গীটারের মতো এরপর যার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর জীবন যুদ্ধে গীটার বেজেছিল বন্দুকের মতো।
আজম খান শুধু একটি নাম নয় বাংলা ব্যান্ড জগতের একটি প্রতিক। একটি উজ্জ্বল তারা, একটি স্বাধীনতা। ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০ সনে তিনি জন্ম লাভ করেন। মৃত্যূবরণ করেন ২০১১ এর জুন মাসে। মাত্র ৩০ বছরের সুর সাধনার জীবনে তিনি বাংলাদেশকে যে গান উপহার দিয়েছেন তা বাংলাভাষাভাসী মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে স্বরণ করবে।
তার সর্ব প্রথম জনপ্রিয় গান হচ্ছে, রেল লাইনের ঐ বস্তিতে (বাংলাদেশ)। অবশ্য এর আগেও তার আরেকটি গান জনপ্রিয় হয়, এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে। তবে তাকে বেশি খ্যাতি এনে দেয় বাংলাদেশ গানটি।
সারাদেশে তখন বাংলাদেশ নামের গানটি তুমুলভাবে ছড়িয়ে পড়ে তার এই গান। ছোট বড় সব বয়সী মানুষের হৃদয় কেড়ে নেয় এই গান। এরপর তার শুধু সৃষ্টিই হয়েছে, জন্ম নিয়েছে একের পর এক তুমুল জনপ্রিয় সব গান। তার গান দর্শক হৃদয়ে এক আলাদা ব্যাঞ্জনা তৈরি করে। আজম খান মানেই হৃদয় নিংরানো কষ্টের সব গান। তার গানের কথা ও সুর দর্শককে এক নতুন জগতের সন্ধান দেয়। তবে বেশ কিছু রোমান্টিক ও মজার গানও তিনি করেন। এর মাঝে আলাল ও দুলাল, চুপ চুপ চুপ, অনামিকা চুপ গানটিও উল্লেখযোগ্য।
তার বিখ্যাত গানগুলো হলো, আমি যারে চাইরে তারে আমি পেয়েও হারাইরে, হারিয়ে গেছে খুঁজে পাবোনা, নেই কোন অভিযোগ, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, জীবনে কিছু পাব নারে, জীবনে মরণ কেন আসে, আলাল ও দুলাল, সারা রাত জেগে জেগে, অভিমানী তুমি কোথায়, চাঁদকে ভালোবেসো না, বধুয়া কি গাইতে জানে গান? এগুলো ছাড়াও তার আরো অসংখ্য বিখ্যাত গান রয়েছে।
তার বাবার নাম মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান, মা জোবেদা খাতুন। সেখানে তারা ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। তার বাবা ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার। ব্যক্তিগতভাবে হোমিওপ্যাথির চিকিত্সক ছিলেন। তার তিন ভাই ও এক বোন ছিল। ১৯৫৫ সালে তিনি প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে বেবিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান। এরপর থেকে সেখানে বসতি তাদের। সেখানে তিনি কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে এসে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত প্রচার করেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে, তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে সঙ্গী হন তার দুই বন্ধু। এসময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা। ঢাকায় তিনি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত ‘অপারেশান তিতাস’। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান শেরাটন হোটেল), হোটেল পূর্বাণী’র গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য, ঐ সকল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে যে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন।
আজম খানের কর্মজীবনের শুরু প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকের শুরুতে। ১৯৭১ সালের পর তার ব্যান্ড উচ্চারণ এবং আখন্দ (লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ) ভাতৃদ্বয় দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে করলেন অনুষ্ঠান। ১৯৭২ সালে বিটিভিতে সেই অনুষ্ঠানের এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে ও চার কালেমা স্বাক্ষী দেবে গান দু’টি সরাসরি প্রচার হলো। ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিলো এ দু’টো গান। দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়ে গেলো তাদের দল। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাংলাদেশ (রেললাইনের ঐ বস্তিতে) শিরোনামের গান গেয়ে হৈ-চৈ ফেলে দেন। বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড-রক ঘরানার গান জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে!তিনি দাবী করেন এটি বাংলা গানের ইতিহাসে- প্রথম হার্ডরক!
১৯৮১ সালের ১৪ই জানুয়ারি ঢাকার মাদারটেকে তিনি সাহেদা বেগমকে বিয়ে করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর। তার এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। প্রথম সন্তানের নাম ইমা খান এবং দ্বিতীয় সন্তানের হৃদয় খান এবং তৃতীয় সন্তানের নাম অরণী খান। সহধর্মিনী মারা যাবার পর থেকে একাকী জীবনযাপন তার। নিয়মিত খেলাধুলা করতেন। খুব ভাল ক্রিকেট ফুটবল খেলতেন তিনি। । ১৯৯১—২০০০ সালে তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতেন। তিনি গড ফাদার নামক একটি বাংলা সিনেমায় ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হিসেবে কাজ করেন।
খুব সহজ সরল জীবন যাপন করতেন তিনি। যদিও ১৭ টিরও বেশি হিট গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে বাজারে। কিন্তু কপিরাইটের কারচুপির কারণে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তাঁর ছিল না। আর এই টাকার অভাবেই সিঙ্গাপুরে ক্যান্সারের চিকিৎসা হতে পারেনি।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দুরারোগ্য ব্যাধির সংগে লড়াই করে অবশেষে পাঁচ জুন ২০১১ইং রবিবার সকাল ১০টা বেজে ২০ মিনিটে ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যূতে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। হাজার হাজার মানুষ শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানালেন পপগুরু আজম খানকে। জানাজার পর আজম খানের কফিন আনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে ভক্ত, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় প্রয়াত শিল্পীকে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দল, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন একে একে শ্রদ্ধা জানায় তার প্রতি। অনেকেরই চোখে ছিলো জল। ৬ জুন মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যদায় তাকে দাফন করা হয়েছে।
留言