পৃথিবীর সবথেকে ভাল মানুষ হল, বাংলাদেশের মানুষ.. মনিকা রায়।
Manika Roy, President Shilpakala Academy USA,
Inc.cultural Secretary,Bangladesh Society Inc.
মনিকা রায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এর বাংলা কমিউনিটির এক পরিচিত মুখ। একজন বাঙালি নারী। দীর্ঘদিন ধরেই নিউইয়র্কে বিভিন্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি। বর্তমানে তিনি শিল্পকলা একাডেমী, যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি, ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সোসাইটির, কালচারাল সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিই একমাত্র বাঙালি নারী সংগঠক যিনি, নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সোসাইটির ২০১৪ সালের কার্যকরী কমিটি নির্বাচনে আটত্রিশ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কালচারাল সেক্রেটারী পদে নির্বাচিত হন।
মনিকা রায় চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থানায় জন্ম গ্রহন করেন । সংস্কৃতিক পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা তার । ছোট বেলা থেকেই গান, নাটক, কবিতা উপন্যাসের মধ্যেই ডুবে থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। তার বাবা একজন আদর্শবান স্কুল টিচার ছিলেন, পাশাপাশি তিনি শিল্প ও সংস্কৃতিপ্রেমী একজন মানুষও ছিলেন । শিশু বয়স থেকেই বাবার এই আদর্শকেই লালন করে আসছেন মনিকা রায়। এক সময় গান করতেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান বাঁশরীতে। গানের পাশাপাশি বাংলা নাটক, কবিতা আর বাংলা সংস্কৃতি অংঙ্গনের সব ক্ষেত্রেই বিচারন ছিল তার। আর সে কারনেই সামাজিক ও সংস্কৃতিক অংঙ্গনে কাজ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন মনিকা রায়।
প্রবাস জীবন,
১৯৯৮ সালে দুই সন্তান বাংলাদেশে রেখে মেজ ভাইয়ের সাথে লন্ডনে চলে আসেন তিনি। পরবর্তীতে জীবিকার অন্বেষণে সেজ ভাই এর কাছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস জীবন শুরু করেন। শুরুতেই পথটা মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, তার কারনটা ছিল ইমিগ্রেশন জটিলতা। একটি নতুন রাষ্ট্র, নতুন জীবন, সব মিলিয়ে দীর্ঘ এক যুগের ও বেশী সময় তাকে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে। একজন নারী হওয়া সত্বেও দিন রাত মিলিয়ে প্রায় আঠের ঘন্টা কাজ করেন তিনি। নিজের বেচে থাকা ও সন্তানদের সকল দায়িত্বই তিনি একাই বহন করেন। বর্তমানে তার বড় ছেলে এমবিএ শেষ করে ঢাকায় বাংলাদেশ পুলিশের এস. আই পদে নিয়োজিত আছেন এবং ছোট ছেলে কম্পিউটার ব্যবসায়ী। সন্তানদের মানুষের মত মানুষ হওয়ার ব্যাপরে তিনি তার জীবনসঙ্গী প্রান প্রিয় প্রয়াত স্বামী প্রসংঙ্গে বলেন, সন্তানদের বাবাই তাদের বেড়ে উঠার বিষয়ে বেশীর ভাগ ভুমিকা পালন করেছিলেন বলেই আজ তারা মানুষের মতন মানুষ হয়েছে। তিনি একজন ভাল বাবা ছিলেন।
প্রবাস জীবনে মনিকা রায়ের একটাই আক্ষেপ, একজন মা তার সস্তানদের স্নেহ ভালবাসার বন্ধন থেকে দুরে থেকে প্রবাস জীবনে যে সংগ্রাম করে চলেছেন দীর্ঘ চৌদ্দ বছর যা নিতান্তই মানবেতর। তিনি একজন মা যিনি তার সন্তানদের কাছ থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থেকেছেন.. এটা একটা মায়ের জন্য কতটা কষ্টদায়ক অনুভুতি যা ঐ পরিস্থিতিতেই শুধুমাত্র একজন মা ই বুঝতে পারবেন । এত কষ্টের মধ্যেও হাল ছাড়েননি তিনি। সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সংগ্রাম করছেন প্রবাস জীবনে।
প্রবাসে কর্ম জীবন,
মনিকা রায় সবসময়ই বাংলা শিল্প সংস্কৃতির মধ্যেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে বেশি পছন্দ করেন এটাই তার আত্নতৃপ্তি। মনিকা রায় প্রবাস জীবনে সবসমই স্বপ্ন দেখতেন, প্রবাসে তার দেশীয় বাংলা শিল্প সংস্কৃতিকে কিভাবে বাংলা কমিউনিটির কাছে তুলে ধরা যায়। সে চিন্তা ভাবনা থেকেই তিনি কাজও শুরু করেন । নিজেকে সম্পৃক্ত করেন উত্তরন শিল্পী গোষ্ঠীর সাথে, সেখানে তিনি এক বছর সংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালে ঢাকা, জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির নামেই কোন রকম সরকারী পৃষ্টপোষকতা ছাড়াই পুরোপুরি বেক্তিগত উদ্যোগেই ২১ সদস্য বিশিষ্ট শিল্পকলা একাডেমী, (ইউ, এস, এ) নামক কালচারাল একাডেমি গঠন করেন। বর্তমানে ১০৭ জন সদস্য ও ২৭ জন বিশিষ্ট একটি কার্যকরী কমিটি রয়েছে শিল্পকলা একাডেমী, (ইউ, এস, এ)র এই সংগঠনে। প্রতি বছরই বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে প্রায় পাঁচ থেকে ছয়টি সফল সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়ে থাকে শিল্পকলা একাডেমী থেকে।
মনিকা রায়, বিশ্বাস করেন বাংলা সংস্কৃতি পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি। বাংলা ভাষাকে প্রবাসে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষে তিনি ইউ এস এর ম্যানহাটনএ একটি বাংলা ভাষায় স্কুলও চালান। তিনি বলেন, যারা আমাদের শিশু যাদের এদেশে জন্ম হয়েছে তারা আসলে দুই দেশের সংস্কৃতির মাঝখানে হাবুডুবু খাচ্ছে। এদেরকে বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাস সভ্যতা কৃষ্টি জানাতে হবে এবং তাদের কে সঠিক ভাবে গড়ে তুলতে হলে একটা ভাল মানের বাংলা স্কুল দরকার। সেই চিন্তা থেকেই তিনি ইউ এস এ বাংলাদেশী অরগানাইজেশান ও শিল্পকলা একাডেমী (ইউ এস এ) যৌথ প্রযোজনায় একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা স্কুল গঠন করেন।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন,
মনিকা রায়, যুক্তরাষ্টের নিউইয়র্ক বাংলা কমিউনিটির সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, নিউইয়র্কে অবস্থানরত আমার বাংলাদেশী সকল ভাই বোনদের সম্পৃক্ততা ও নিরালস পরিশ্রম এর ফসল আজকের এই শিল্পকালা একাডেমী, (ইউ, এস, এ), আজ এটা সকল বাংলা শিল্প সংস্কৃতিমনা বাংলাদেশী ভাই বোনদের সংগঠন, এর কৃতিত্ব সকল প্রবাসী বংলাদেশী ভাই বোন দের। বিভিন্ন সময়ে যারা শিল্পকলা একাডেমী, (ইউ, এস, এ) এর প্রতিটি পদক্ষেপে আর্থিক ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করে আসছেন বা ভবিষ্যতেও করার মনোভাব পোষন করেন আমি তাদের সকলের কাছেই কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, আমি মনিকা রায় শুধুমাত্র কাজ করার স্বপ্ন দেখেছি আর এটাকে বাস্তবায়ন করার পিছনে যারা আমাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন তারা হল আমার বাংলাদেশী ভাই ও বোনেরা। লন্ডন, আমেরিকার এই দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা থেকে আমি গর্ব করে বলতে পারি যে, পৃথিবীর সবথেকে ভাল মানুষ হল আমার বাংলাদেশের মানুষ। আমার ভালবাসা শ্রদ্ধা তাদের জন্য আনেক বেশী। আমার এই উদ্যোগ ও সফলতা আজ শুধুমাত্র তাদের জন্যই। আমার সাথে যারা প্রতি মুহুর্তে শ্রম ও অর্থ দিয়ে শিল্পকলা একাডেমিকে পরিপুর্ন করে যাচ্ছেন, ও যারা আমার উপদেষ্টা মন্ডলী তে আছেন, তাদের মদ্ধ্যে যেমন, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আছেন নাদিম আহম্মেদ,(সঙ্গীতজ্ঞ) জীবন চৌধুরী, জামাল উদ্দিন হোসেন সহ অনেকেই। যারা প্রবাসে অনেক দিন থেকেই বাংলা শিল্প সাহিত্যের প্রসারের জন্য কাজ করে আসছেন দীর্ঘদিন থেকেই। আনেকেই আছেন যারা শিল্পকলার সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জরিত তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই বিভিন্য সময় আমি প্রচুর ভালবাসা ও সমর্থন পেয়েছি।
কাজে অনুপ্রেরনা,
প্রবাস জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, তিনি তার সন্তানদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রানিত হয়েছেন, একজন আদর্শ মা হিসেবে এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি ও কাজের অনুপ্রেরনা। তার সন্তানেরা তাকে প্রায়ই বলত, মা তুমি শুধু একজন মা ই নয়, তুমি একজন নারী, মা তুমি তোমার ইচ্ছাটাকে কাজে লাগাও।
নারী সংগঠক মনিকা রায়,
কাজ পাগল একজন মানুষ মনিকা রায় । কাজের ব্যাপারে কোন প্রকার সমঝোতা করতে রাজি নন তিনি। তিনি বলেন, সমাজে একজন নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে টিকে থাকতে হলে কাজ করেই আত্ননির্ভর হতে হবে। এব্যাপারে একজন পুরুষ ও নারীতে কোন প্রকার ভেদাভেদ থাকতে পারে না। সমাজে একজন নারীর পথচলতে যে কোন সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আসুক না কেন, তা সাহস ও বিচক্ষণতার সাথে নারীকেই মোকাবেলা করতে হবে। একজন নারীকেই হতে হবে আরেকজন নারীর সহায়ক শক্তি। আমাদের সমাজের সকল নারীকেই এ মনোভাব পোষন করতে হবে।
শুধুমাত্র নারীদের পারস্পারিক সমঝোতা ও সহমর্মিতাই সমাজে একজন নারীকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। একজন নারীর প্রতি অন্য একজন নারীর ভালবাসা পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতা থাকলে, পুরুষরাও কখনোই নারীকে মর্যাদা হানীকর কোন পরিস্থিতিতে ফেলতে পারবেন না।
Commentaires