top of page

সেদিনটি কেমন কেটেছিল বঙ্গবন্ধুর ?


পরনে ছিল দুধসাদা পাঞ্জাবি। তার ওপর হাতাকাটা কালো কোট। দৃঢ়তার সঙ্গে মঞ্চে উঠলেন দীর্ঘদেহী এক বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সামনে জনসমুদ্র। দরাজ কন্ঠে উচ্চারণ করলেন কালজয়ী সেই ভাষন। সে ভাষন শুধু বাঙালির স্বাধীনতার ঘোষণাই ছিল না, ছিল এক অনবদ্য কাব্য।

বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতা ৭ই মার্চের ভাষণে কী বলেছিলেন, সেই ভাষণের দিক নির্দেশনায় বাঙালি জাতি যে মরণপণমুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল তা আজ কারো অজানা নয়।

কিন্তু সেদিনটি কেমন কেটেছিল বঙ্গবন্ধুর? কীরূপ প্রস্তুতি ছিল তার ভাষণের আগে- এ কথাগুলো এখনো অনেকেরই অজানা।তেমনি অজানা, সেদিন রাতের কথাও।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও ইতিহাস থেকে সংগৃহীত সে দিন ও রাতের বর্ণনা তুলে ধরা হলো পূর্বপশ্চিমের পাঠকের জন্য।

দলীয় নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক:

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সকাল থেকেই ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ভিড় জমাতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

বঙ্গবন্ধুর জামাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘ওইদিন বঙ্গবন্ধু তারবাসভবনের লাইব্রেরি কক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকারমোশতাক আহমেদ, ড. কামাল হোসেনসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নেন।

ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু সবাইকে বলেন, ছাত্রজনতার দাবির সঙ্গে তার একমত পোষণ করেছেন এবং বিকেলে রেসকোর্সেচার দফার দাবি পেশ করা হবে।

এরপর ড. কামাল হোসেনকে চার দফার খসড়া তৈরি করতে বলেন। দুপুরের খাবারের পর তিনি বিশ্রাম নেয়ার সময় তাকে চূড়ান্তকপিটি দেখানো হয়। কপিটি টাইপ করেছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। এ সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে টাইপ কপির সঙ্গে যেন মূল কপিটিমিলিয়ে দেখার নির্দেশ দেন।’

কী ছিল সেই চার দফা:

রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারেরসংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে মন্ত্রের মতো সেইসব উচ্চারণ আজো প্রতিটি বাংলাদেশিকে উদ্বেলিত করে।

যে কোনো আন্দোলনে তার সেই ভরাট কণ্ঠস্বর প্রেরণা জোগায়। অথচ সেদিন যখন ভাষণের ঘোষণাপত্র তৈরি হচ্ছিল সেখানেবঙ্গবন্ধুর ভাষণের এসব কথার কোনো ছাপই ছিল না। ঘোষণাপত্র প্রসঙ্গটি বিস্তারিত উঠে এসেছে এম এ ওয়াজেদ আলীরস্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে-

‘সেদিন ৭ই মার্চে ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত কপিটি মিলিয়ে দেখার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু খন্দকার মোশতাককে জিজ্ঞেস করেন যে, ‘ইশতেহারে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে কি না।’ তিনি বলেন যে, ‘সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে জারিকৃতআইনগত কাঠামোর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে পাকিস্তানের অখণ্ডতালঙ্ঘন সংক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার ব্যাপারটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং, এই ব্যাপারটা ইশতেহারে লেখা হয়নি।’

সেদিনের ইশতেহারে ইয়াহিয়া খানের কাছে চার দফা দাবি করা হয়। দাবিগুলো হলো: ১. সামরিক বাহিনীর সমস্ত লোককে ব্যারাকেফিরিয়ে নিতে হবে। ২. পহেলা মার্চ হতে আন্দোলনে যে সমস্ত ভাইবোনকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্নতদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে সে ব্যাপারে দায়ি ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। ৩. সামরিক আইনঅবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। ৪. অবিলম্বে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত পাকিস্তান জাতয়ি পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্তদলের নেতার কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’

রেসকোর্সের পথে:

রেসকোর্সে রওনা হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন নেতাকর্মীকে ডেকে বলেন, ‘চার দফার এই ইশতেহারটি দেশি ও বিদেশিসাংবাদিকদের মাঝে বিলি করবে।’ এই বলে তিনি একটি ট্রাকে উঠে যাত্রা করেন।

এ সময় সেই ট্রাকে ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ ফজলুল হক মণি, ছাত্রলীগের প্রাক্তনসহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

এছাড়া মোস্তফা মহসীন মন্টু, কামরুল আলম খসরু, মহিউদ্দিন, আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজসহ অন্যান্য নেতাকর্মীরাঅন্য একটি ট্রাকে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার হঠাৎ করে বন্ধ:

সেদিন রেসকোর্সে নৌকা আকৃতির সভামঞ্চটি স্থাপন করা হয়েছিল বর্তমান শিশুপার্কের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে যাওয়ারপর একটি গাড়ি নিয়ে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের সঙ্গে যাত্রা করেন ওয়াজেদ মিয়া। মঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছে শেখ হাসিনা রেডিও চালুকরতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচারের কথা এসময় রেডিওতে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছিল। কিন্তু ভাষণ শুরু হওয়ার কয়েকমিনিটের মধ্যেই রেডিও নিস্তব্ধ। সম্প্রচারের অনুমতি থাকার পরও সরকারের তাৎক্ষণিক নির্দেশে ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়াহয়।

সেদিন রাতে ইকবাল বাহার চৌধুরীর নেতৃত্বে রেডিও পাকিস্তান কেন্দ্রের সকল কর্মকর্তা ৩২ নম্বরের বাসায় এসে বঙ্গবন্ধুকে জানানযে, এ ভাষণ সম্প্রচার করতে না দেয়া পর্যন্ত তারা কাজে যোগ দেবেন না। এদিন রেডিও পাকিস্তানের সব অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল।

৮ মার্চ সকাল ৮টায় পাকিস্তান রেডিও ঢাকা কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ হুবহু সকাল ৯টায় প্রচার করা হবে।

এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘রেডিওর ঘোষকরা আগে থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাত দৃঢ় দর্শকেরনজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা প্রচার করতে শুরু করে।’

তিনি আরও লেখেন, ‘এই ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর হস্তক্ষেপ করে এই বাজে ব্যাপারটি বন্ধের নির্দেশ দেন। সে কথামতো আমি রেডিও কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিই। আদেশটি শুনে টেলিফোনের ওপারে থাকা বাঙালি অফিসার আমাকে বলেন, ‘‘আমরাযদি সাড়ে সাত কোটি জনগণের কণ্ঠ প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করব না।’ এই কথার সঙ্গে সঙ্গে বেতার কেন্দ্রনীরব হয়ে যায়।

আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে খাবে:

রেসকোর্স ময়দানে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু রাতে পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসেন। এসময়বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া, শেখ কামাল, শেখ জামাল, রেহানা, রাসেল ও শেখ শহীদ উপস্থিতছিলেন। বঙ্গবন্ধু এসময় গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমার যা বলার ছিল আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখনআমাকে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে খাবে।’

সেদিন থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবার তার সঙ্গে খেয়েছেন।

তথ্যসূত্র: ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’-মুনতাসীর মামুন

  • Twitter Social Icon
  • Facebook Social Icon
  • Google+ Social Icon
  • LinkedIn Social Icon
Follow
"SAREGAMA JUST IN"

  জনপ্রিয় সংবাদ সা রে গা মা

বাংলা গান সা রে গা মা

Print  / Press Ctrl+P
Saregama Bangla

Sa Re Ga Ma News Archive

Write Yours Comments. 

RSS Feed

Reproduction of any content, news or article published on this website is strictly prohibited Privacy. 

bottom of page