প্রিয় সহকর্মীর মৃত্যুতে সমবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্র শিল্পী সমাজ।
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর রোববার বিকাল ৪টা ৫মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নন্দিত এই অভিনেত্রী। প্রিয় মানুষকে হারানোর শোকের এই ছায়া পড়েছে পুরো চলচ্চিত্রাঙ্গনেও। সদ্য প্রয়াত অভিনেত্রী দিতির সহশিল্পীদের স্মৃতিচারণ নিয়ে এই প্রতিবেদন।
কত সহজেই মৃত্যুলোভী পিশাচ ক্যানসার জীবনের ছন্দ কেড়ে নেয়, হাসি কেড়ে নেয় - ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে যায় জীবন। মৃত্যু কত নিষ্ঠুর। কত অসহায় এই নিছক ‘জীবন’! প্রিয় সহকর্মীর মৃত্যুতে সমবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্র শিল্পী সমাজ।
শবনম: দিতির সাথে আমি দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। একটি পাকিস্তান বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ‘লেডি কমান্ডো’ ও অন্যটি সুভাষ দত্তের ‘সহধর্মিনী’। আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ ছিলো দিতি। সবসময়ই তার মুখে হাসি লেগে থাকতো। এমন মানুষ ইন্ডাস্ট্রিতে বিরল। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
উজ্জ্বল: দিতির প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘আমিই ওস্তাদ’ চলচ্চিত্রে আমি তার বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘রাজা বাবু’তে আমার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলো সে। সত্যি বলতে কী খুব দুঃখ হয় দিতির এভাবে চলে যাওয়াটা নিয়ে। এটা সত্যি যে শিল্পীদের অনেক যুদ্ধ করতে হয়, সংগ্রাম করতে হয়। দিতির সেই সাহস ছিলো যুদ্ধে জয়ী হওয়ার। জীবন যুদ্ধে দিতি জয়ী হয়েছিলো। কিন্তু মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে তাকে হার মানতে হলো। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।
ববিতা: দিতি আর আমি বলা যায় একই পরিবারের সদস্য। সোহেল খুন হওয়ার পর মেয়েটা খুব কষ্ট করে দুই ছেলে-মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করেছে। সত্যি বলতে কী দিতি আমার জুনিয়র হলেও তার সাথে আমার সম্পর্কটা ছিলো বন্ধুর মতো। আউটডোরে যখন শ্যুটিং করতাম তখন আমরা এক গাড়িতে করেই শ্যুটিংয়ে যেতাম। চলতে চলতে পথ হয়তো শেষ হয়ে যেতো কিন্তু গল্প শেষ হতো না। আমার নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকে ‘চন্ডিদাস ও রজকিনী’ চলচ্চিত্রে তাকে নিয়ে কাজ করেছি। একজন ডেডিকেটেড শিল্পী ছিলো দিতি। তার সাথে ‘দোষী’, ‘চার সতীনের ঘর’ সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। সর্বশেষ তাকে যখন দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম তখন আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চুমো খাচ্ছিলো বার বার। সেই শেষ স্মৃতি কখনোই ভুলবো না। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেশতবাসী করেন।
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমাদের প্রত্যেককেই দিতির মতো একদিন চলে যেতে হবে। তার এভাবে চলে যাওয়া থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে যে আমাদেরকে যেকোনো সময় আল্লাহর কাছে চলে যেতে হবে। দিতি আমার একজন ভালো সহকর্মী ছিলেন। তার চলে যাওয়ায় শুধু একটি কথাই বলবো আর তা হলো আল্লাহ যেন তার গুনাহ ক্ষমা করে দিয়ে তাকে বেহেশত নসিব করেন।
শর্মিলী আহমেদ: দিতির সাথে পেশাগত সম্পর্কের বাইরে পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো আমার। আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতো। বিশেষ করে তার মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমাকেই যেন মা বলে ডাকতো সবসময়। তার নির্দেশনাতে শেষ কয়েকটি কাজ আমি করেছি। আমাকে প্রায়ই বলতো, ‘মা তুমি ছাড়া কাজ করতে আমার ভালো লাগে না।’ আমার গর্ভে হয়তো তাকে ধরিনি। কিন্তু সে ছিলো আমার বড় মেয়ে। তার এভাবে চলে যাওয়াটা একজন মা হিসেবে আমি মেনে নিতে পারছি না। এতো অল্প বয়সে তাকে এভাবে চলে যেতে হবে এটা কল্পনা করিনি কখনোই। সত্যিই আজ বড় কষ্ট হচ্ছে দিতির কথা ভেবে। প্রতি মুহূর্তেই ভাবছি হয়তো একটু পরেই পিছন থেকে আমাকে ধরে ‘মা’ বলে ডাক দিবে।’
ডলি জহুর: গত বছর ৩১ মার্চ দিতির জন্মদিনে আমরা কতোই না মজা করেছিলাম, সে স্মৃতি আজ চোখে ভাসছে। আমার দোস্ত ছিলো দিতি। আমরা কেউ কখনোই জিজ্ঞেস করিনি কার বয়স কতো। দিতি আর আমি যখন টিভিতে একসাথে কাজ করি তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। তারপরতো সে ফিল্মে কাজ শুরু করলো, আমিও ফিল্মে কাজ শুরু করলাম। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হলো। কিন্তু তার সাথে শেষ দেখা হলোই না। কারণ আমি এখন অস্ট্রেলিয়া। দোয়া করি আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।
অপূর্ব: দিতি মায়ের সাথে তার নির্দেশনাতে কাজ করার আগে থেকেই আমার পরিচয় ছিলো। তিনি প্রথম যেদিন আমাকে তার নির্দেশনায় নাটকে কাজ করার জন্য ফোন করেছিলেন আমার আজো মনে আছে, ‘আমি শুধু বলেছিলাম-আপনার কবে ডেট লাগবে বলেন।’ একথা শুনে তিনি অবাক হয়ে আমাকে বললেন, ‘শিগগিরই তোমাকে জানাচ্ছি।’ এরপরতো তার নির্দেশনায় প্রথম কাজ করেছি এবং পরে আরো বেশ কয়েকবার কাজ করেছি। একজন মমতাময়ী মা-ই ছিলেন তিনি আমার কাছে। তার সাথে শেষ দেখা হয়েছে তার নির্দেশিত নাটকেই কাজ করতে গিয়ে। এরপর আর দেখা করার সুযোগ হয়নি। তাই নিজেকে আজ কিছুটা অপরাধীও মনে হচ্ছে। তবে দোয়া করি আল্লাহ যে মা’কে বেহেশত নসিব করেন।
আমিন খান: দিতি আপুর সাথে আমি একটি মাত্র চলচ্চিত্রে ‘বোনের মতো বোন’। এই চলচ্চিত্রে তিনি আমার বড় বোনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই থেকে তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো আদর স্নেহ করতেন। এমন একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ এভাবে চলে যাবেন ভাবিনি কখনো। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।
রিয়াজ: দিতি আপুর সাথে চলচ্চিত্রের আসার প্রথমদিন থেকেই আমার বেশ ভালো পরিচয় এবং পারিবারিক সম্পর্ক। সৈয়দ হারুনের একটি চলচ্চিত্রে তার সাথে প্রথম অভিনয় করি। এরপর ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’, ‘সুইটহার্ট’সহ আরো বেশকিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করি। একজন মানুষ কতোটা উদার আর মহান হতে পারেন দিতি আপা ছিলেন তার যথাযথ উদাহরণ। এমন মানুষ সত্যিই আমাদের চলচ্চিত্র জগতে খুবই কম আছেন। তার এভাবে চলে যাওয়াটা সত্যিই মেনে নেবার মতো নয়। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসীব করেন।
ওমর সানী: দিতির সাথে প্রথম কাজ করি সৈয়দ হারুনের নির্দেশনায় ‘চরম আঘাত’ চলচ্চিত্রে। এরপর আর কাজ করা হয়ে উঠেনি। তবে আমরা সর্বশেষ বদিউল আলম খোকনের নির্দেশনায় ‘রাজা বাবু’ চলচ্চিত্রে এক সাথে কাজ করি। এটি ছিলো দিতি অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন।
ফেরদৌস: আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘কাল সকালে’ চলচ্চিত্রে দিতি আপুর সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। এরপর আর কাজ করার সুযোগ হয়নি। দিতি আপু অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তার মতো এতো বিনয়ী, এতো হাসিখুশি মানুষ চলচ্চিত্রে দেখিইনি আমি। আমার দুভার্গ্য যে হয়তো তাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারবো না। কারণ আমি একটি জরুরি কাজে দিনাজপুর এসেছি।
শাহনূর (লন্ডন থেকে): দিতি আপুর মৃত্যুর খবর শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম অন্যান্য সময়ের মতো গুজবই হবে। কিন্তু শেষতক শুনলাম সত্যিই দিতি আপু আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি লন্ডনে আছি, আপুর সাথে শেষ দেখাটা হবেই না। এ কেমন ভাগ্য আমার। অথচ তিনি আমার বড় বোনেরই মতো। আপুর সাথে জীবনে একটি মাত্র ছবিতে অভিনয় করেছি। সেটি হলো ‘রাজা বাবু’। নাটকে অভিনয় করেছি ‘জীবনের গল্প’, ‘জীবন সংসার’সহ আরো বেশ ক’টি নাটকে। সবই যেন আজ স্মৃতি হয়ে চোখে ভাসছে।
পূর্ণিমা: চলচ্চিত্রে আমার প্রিয় মানুষদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন দিতি আপা। তার এভাবে চলে যাওয়াতে সত্যিই ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেলো আমাদের। দিতি আপু শুধু একজন অভিনেত্রীই ছিলেন না আমাদের একজন অভিভাবকও ছিলেন। তার সাথে ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’ চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। একজন মানুষ কতোটা বড় মনের হতে পারে তিনি যেন তারই উদহারণ।
ওমর সানি : হ্যাঁ আমি শুনেছি। এখন ইউনাইটেড হাসপাতালে যাচ্ছি (অনেকটা ধরা কণ্ঠে)। ওনাকে (দিতি) নিয়ে এত স্মৃতি জমা আছে যে, তার কটা বলব (এ কথা বলেই কেঁদে ফেলেন এই অভিনেতা)। আমি একটু স্টেবল হয়ে নেই। তারপর কথা বলি?
মাহিয়া মাহি : আমি শ্বাশু মার (দিতি) সঙ্গে তবুও ভালোবাসি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। এ চলচ্চিত্রে উনি আমার শ্বাশুরির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তারপর থেকেই আমি ওনাকে শ্বাশু মা বলে ডাকতাম। উনি অদ্ভুদ একজন মানুষ ছিলেন। অনেক ভালো একজন মানুষ ছিলেন। মানুষের টাকার প্রতি একটা নেশা থাকে। উনার মধ্যে এই বিষয়টি ছিল না। অভিনয় করে যে টাকা আয় করতেন তা নিয়ে ঘুরা-ফেরা ও আনন্দ করে ব্যয় করতেন। আমি শ্বাশুমার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
ইমন : আমি কিছুক্ষণ আগে এই দুঃসংবাদটি পেয়েছি। এখন আমি শুটিংয়ে আছি। খবরটি শোনার পর শুটিংও ঠিকমতো করতে পারছি না। খুব খারাপ লাগছে। কষ্ট লাগছে। আমি দিতি আপুর সঙ্গে অন্তরঙ্গ চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। এই চলচ্চিত্র চাষী নজরু ইসলাম স্যারের সর্বশেষ চলচ্চিত্র। দিতি আপু অভিনীতও শেষ চলচ্চিত্র এটি। নজরুল স্যার অসুস্থ হওয়ার পর আমি আর দিতি আপু শুটিং সেটে আলোচনা করছিলাম, সিনিয়র সবাই কেমন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তারপর-ই অসুস্থ হন দিতি আপু। অবশেষে উনিও চলে গেলেন। গুরুজন, প্রিয়জনকে একএক করে হারাচ্ছি। দিতির মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক হয়ে উঠেছে শোকবই। তারকারা নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন—
নীরব : হারাতে চাই না তবুও হারায় দিতি ম্যাডাম।
কেয়া : খুব কষ্ট হচ্ছে দিতি আপি আমাদের মাঝে নেই শুনে। আল্লাহ দিতি আপিকে জান্নাতবাসী করুক।
নুসরাত ফারিয়া : দিতি ম্যাডাম, আল্লাহ আপনাকে শান্তিতে রাখুন।
শাহরিয়াজ : দিতি আপু ছিলেন আছেন থাকবেন আমাদের স্মরণে… ঢালিউডের ইতিহাসে।
ইলোরা গহর : দিতি আপা নাকি মারা গেছেন বিশ্বাস করতে পারছি না।
উর্মিলা শ্রাবন্তী কর : তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।
কায়েস আরজু : আমাদের প্রিয় দিতি আপা আর আমাদের মাঝে নেই।
তানহা মৌমাছি : আল্লাহ তোমায় জান্নাতবাসী করুক।
দিনাত জাহান মুন্নী : আজ বিকাল ৪টায় দিতি আপা চলে গেলেন এই পৃথিবী ছেড়ে— ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজেউন।
মাসুম রেজা : দিতি আপা আমার ‘ভবের হাট’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন.. তাঁকে কুষ্টিয়া্র ডাইলেক্ট শেখাতে তেমন সময় লাগেনি.. তিনি সুঅভিনেত্রী সহজেই তুলে নিয়েছিলেন.. নাটকে তিনি তার নিরুদ্দেশ স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করতেন আর কাঁদতেন.. একদিন তিনি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেও নিরুদ্দেশে যান.. তেমন নিরুদ্দেশেই তিনি চলে গেলেন আজ.. ভালো থাকবেন দিতি আপা…।
নিলয় আলমগীর : আমরা আপনাকে মিস করবো।
শাহনেওয়াজ কাকলী : দিতি আপা ভালো থাকবেন, আমরাও একদিন আপনার কাছে পৌঁছাবো… এটাই যে সত্য।
আলমগীর কবির / রাইজিং বিডি ও ঢালিউড টুয়েন্টিফোর অবলম্বনে।