নতুন প্রজন্মের কাছে রোল মডেল হিসাবে আমরা কি ভুল মানুষদের তুলে ধরছি ?
এসব বিষয়ে নিয়ে লিখেছেন আমেরিকায় বাংলাদেশের গর্ব কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. রাগিব হাসান"
( সহকারী অধ্যাপক আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয় বার্মিংহাম, কম্পিউটার ও তথ্য বিজ্ঞান বিভাগ।)
রোল মডেল ? ~
সোশাল মিডিয়ার একটা সুবিধা হলো, মোটা দাগে নানা ট্রেন্ড ধরা যায়। একটা পোস্ট থেকে না, বরং হাজার হাজার পোস্ট দেখে সামাজিক গতিধারা, চিন্তা চেতনার দিকটা কিছুটা আন্দাজ করা চলে। সেই সুবাদে অনেক দূর থেকেও বোঝা যায়, আজকের সমাজের রোল মডেল কারা।
কারা সেই রোল মডেল? প্রশ্নটাকে অন্যভাবে করি। ধরা যাক, কোন একজন, ধরুন একজন বিজ্ঞানী, খুব বড় একটা আবিষ্কার করলেন। ধরা যাক, সেই আবিষ্কারকে প্যাটেন্ট করে আগলে রাখ্লে সেখান থেকে তাঁর আয়ের সম্ভাবনা প্রায় ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি ডলার। পক্ষান্তরে প্যাটেন্ট করে রাখলে সস্তায় সেটা আম জনতাকে দেয়া যাবে না। সেই আবিষ্কারের সুফল ভোগ করবে কোটি কোটি মানুষ, তাঁদের জীবনকে রক্ষা করবে।
এখানে দুই রকমের সম্ভাবনা আছে।
১) বিজ্ঞানীটি এই আবিষ্কারটিকে প্যাটেন্ট করে একটি কোম্পানি খুলে ৭ বিলিয়ন ডলার কামিয়ে নিলেন। এবং বিশ্বের সেরা ধনী ও উদ্যোক্তাদের খাতায় নাম লেখালেন।
অথবা
২) বিজ্ঞানীটি এই আবিষ্কারের প্যাটেন্ট না করে আম জনতার উপকারের জন্য এটাকে ছেড়ে দিলেন।
উপরের কোন জন আপনার রোল মডেল? বর্তমানে সোশাল মিডিয়াতে যে ট্রেন্ড দেখছি, তাতে করে ১ম বিজ্ঞানী, মানে আবিষ্কারটাকে নিজের ব্যক্তিগত ভোগে লাগাবার জন্য লেগে থাকা ব্যক্তিদেরই ধরা হয় রোল মডেল, ধন্য ধন্য করা হয় সেরকম কাউকে, যার গাদাগাদা প্যাটেন্ট আছে (আবিষ্কার মুখ্য নয়, প্যাটেন্ট করে সেটাকে আগলে রাখাই মুখ্য!)। জ্ঞান সবার, কিন্তু সেই জ্ঞান বা নতুন আবিষ্কার দিয়ে মানবজাতির উন্নয়নের বদলে সেটার ব্যবসাটাই কোনো কারণে বড় করে দেখানোর চল দেখছি।
এমন না যে উদ্যোগের ব্যবসার সুফল নাই। অবশ্যই যে কোনো আবিষ্কারকে সামনে এগিয়ে নিতে সেটার পিছনে বড় উদ্যোগ লাগবে, আবিষ্কার করার জন্য বিজ্ঞানীদের কিছু প্রণোদনা লাগবে বটে। কিন্তু জ্ঞান বা আবিষ্কারের এবং তা দিয়ে সবার উপকারের বদলে যখন সেটা নিয়ে কে কত টাকা কামিয়ে নিতে পারলো, সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, এবং তার মানদণ্ডেই ধন্য ধন্য করা হয় ব্যবসায়ী মানসিকতার সবাইকে, তখন মনে হয়, নতুন প্রজন্মের কাছে রোল মডেল হিসাবে আমরা কি ভুল মানুষদের তুলে ধরছি?
১০০ জন রোল মডেলের সবাইকে কেনো উদ্যোক্তা হতে হবে, জ্ঞানকে আগলে রেখে টাকা কামাবার স্বপ্ন দেখবে? কেনো অন্তত ১ বা ২ জন সেই বিজ্ঞানীর মতো হবে না, যিনি ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো বিশাল অংকের টাকাকে উল্লেখ করে বলেছিলেন, প্যাটেন্ট কেন করবো? সূর্যের আলোকে কি প্যাটেন্ট করে আগলে রাখা যায়?
আমাজনের মালিক জেফ বেজোস কিংবা নানা কোম্পানির মালিক এলোন মাস্কের পাশাপাশি আমাদের তরুণদের অন্তত দুই একজনের রোল মডেল হোক সেই বোকা বিজ্ঞানী জোনাস সাল্ক (Jonas Salk) এর মতো কেউ। যিনি পোলিওর টিকা আবিষ্কার করে কোটি কোটি শিশুকে পোলিওর পক্ষাঘাত কিংবা মৃত্যুর হাত থেকে রাতারাতি বাঁচিয়ে তুলেছিলেন, আর তার পর সেই আবিষ্কারটিকে করেছিলেন সমগ্র মানবতার জন্য উন্মুক্ত, ৭ বিলিয়ন ডলারের প্যাটেন্টের লোভ এড়িয়ে বলেছিলেন, সূর্যের আলোকে কি প্যাটেন্ট করে আগলে রাখা যায়?
আজ হোক কাল হোক, সাড়ে তিন হাত মাটিই আমাদের ঠিকানা। বিলিয়ন ডলার থাকুক বা না থাকুক। ব্যবসার বিশাল টাকা পয়সা কারো মৃত্যু এড়াতে পারেনি। আমাদের তরুণদের রোল মডেল হিসাবে ১০০ জন ব্যবসায়ীর সাথে আসল অন্তত গোটা দুয়েক কিংবা তিনেক বোকা বিজ্ঞানী। যারা জীবনে ডেবিট-ক্রেডিটের হিসাব ভুলে গিয়ে বরং মনের আনন্দে দেখবে,
জ্ঞানের আলোটা কীভাবে আলোকিত করছে বিশ্বের সব মানুষকে।
স্বপরিবারে কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. রাগিব হাসান"