সাইবার অপরাধের বিভিন্ন ধরণ।
পরিচয় চুরি
আজকাল অনলাইনে কেনাকাটা করছেন অনেকে৷ এরজন্য নাম, ঠিকানা, ই-মেল, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য ইত্যাদি দিতে হয়৷ সমস্যাটা সেখানেই৷ যেসব ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো নয়, সেখানে এই তথ্যগুলো দিলে তা অপরাধীর কাছে চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে৷ সেক্ষেত্রে অপরাধী আপনার তথ্য ব্যবহার করে আপনার ক্রেডিট কার্ড শূন্য করে দিতে পারে৷ কারণ আপনার যে পরিচয় চুরি হয়ে গেছে!
স্প্যাম ও ফিশিং
একদিন ই-মেল খুলে দেখলেন আপনি অনেক টাকার লটারি জিতেছেন৷ সেটা পেতে আপনাকে কিছু তথ্য দিতে বলা হচ্ছে৷ হঠাৎ করে বড়লোক হওয়ার লোভে আপনি সেই তথ্যগুলো দিয়েও দিলেন৷ ব্যস, যা হবার হয়ে গেছে৷ পরে দেখলেন টাকা পাওয়ার বদলে আপনার কাছে যা আছে সেটাও চলে যাচ্ছে! অর্থাৎ আপনি ফিশিং-এর শিকার হয়েছেন৷
সাইবারক্রাইম - ফিশিং (Phishing) - ঘোলা পানিতে মুরগি শিকার! ~
ইমেইলটা পড়ে আঁতকে উঠলেন। খোদ ফেইসবুক কিংবা জিমেইল থেকে পেয়েছেন ইমেইল, সেখানে লেখা আপনার ইমেইলে বা ফেইসবুক একাউন্টে কী যেন সমস্যা হয়েছে, জলদি লগিন করে সেটা ঠিক করতে হবে। আপনার সুবিধার জন্য লগিন এর লিংকও দেয়া আছে। বেশ বেশ, আর দেরি কেনো, ক্লিক করে বসলেন। লগিনের সেই চেনা পরিচিত পেইজটাও এসে গেছে। সুন্দর মতো আপনার ইউজারনেইম আর পাসওয়ার্ডটা দিয়ে লগিন করতে গেলেন। প্রথমবারে হলো না। কী যেন এরর মেসেজ আসলো। নির্ঘাত টাইপের ভুল। তাই আবার দিলেন। এবারেও আপনাকে এরর মেসেজ দিয়ে আবার লগিন পেইজে ফেরত পাঠালো। লগিন করে কোনো সমস্যা দেখলেন না, ভাবলেন, যাক বাবা আপদ কেটেছে। সাধের সেলফিটা এই চান্সে পোস্ট করে ব্যস্ত হয়ে গেলেন লাইক গুণতে।
পরের দিন আপনার সেলফি তো বটেই, খোদ একাউন্টটাই লোপাট হয়েন গেলো। কিন্তু ক্যামনে কী?
আপনি শিকার হয়েছেন ফিশিং (Phishing) নামের সাইবার আক্রমণের। আপনার পাসওয়ার্ড সুকৌশলে হয়ে গেছে চুরি।
ঘটনাটা ঘটলো কী করে? আপনাকে যে ইমেইল পাঠানো হয়েছিলো, সেটা আসলে ফেইসবুক কিংবা গুগলের থেকে আসেনি, বরং এসেছিলো সাইবারক্রিমিনালদের কাছ থেকে। ইমেইলের প্রেরকের নাম "ফেইসবুক সিকিউরিটি টিম" বা এরকম দিলেও আসলে ক্লিক করে দেখতে গেলে দেখবেন সেটা গুগলের আসল জায়গা থেকে আসেনি। বরং এসেছে অন্য ডোমেইন থেকে। হয়তোবা গুগলসিকিউরিটিটিম@আবুলডটকম এই টাইপের ঠিকানা থেকে। আপনি হয়তোবা ভাবলেন গুগলের নাম আছে, তাহলে নির্ঘাৎ এটা আসল জায়গার। আর ইমেইলের ভিতরে ভাবখানা গুগলের বা ফেইসবুকের মতো হলেও আসলে সেটা সাইবারক্রিমিনালদের লেখা ইমেইল। আপনাকে ধোঁকা দিয়ে তাদের দেয়া লিংকে ক্লিক করানোই উদ্দেশ্য।
কিন্তু তাতে লাভ? চেনা পরিচিত গুগল বা ফেইসবুকের বা আপনার ব্যাংকের লগিন পেইজ তো দেখেছেন, তাই না?
সেটাও দুই নম্বর! আসল লগিন পেইজের ছবি ও লেখা চুরি করে সাইবারক্রিমিনালেরা বানিয়ে রেখেছে নকল লগিন পেইজ। দেখতে হুবুহু একই রকমের। কেবল পার্থক্য হলো উপরে এড্রেস বারে গুগলের বা ফেইসবুকের আসল লগিন পেইজের ঠিকানার বদলে ক্রিমিনালদের দখলে থাকা কোনো সার্ভারের পেইজের ঠিকানা আছে। কিন্তু অতোশতো কে দেখে, তাই না? আপনি তো দেখেন না এসব ছোটখাট জিনিষ। তাই দেখতে একই রকম লাগে সুতরাং সব ঠিক আছে -- এহেন বখাট্য যুক্তিতে বিশ্বাস করে সুন্দর আপনার ইউজার নেইম আর পাসওয়ার্ড এন্টার করেছেন সেই পেইজে। করা মাত্র ক্রিমিনালদের কাছে সেটা পাঠিয়ে দেয়া হয়, আর আপনাকে পাঠানো হয় আসল ফেইসবুক বা গুগলের লগিন পেইজে। এবারে লগিন করতে গেলে ঠিকমতোই লগিন হবে, আর আপনিও করবেন না সন্দেহ, কারণ আসল গুগলেই তো ঢুকেছেন।
আপনার অজান্তেই আপনি হয়ে পড়লেন ফিশিং এর শিকার। (হ্যাকার জগতে এভাবে মানুষকে বোকা বানিয়ে মুরগি ধরার মতো কাজটাকে ফিশিং (phishing, ইচ্ছা করেই অন্য বানানে লেখা) বলা হয়। আপনার পাসওয়ার্ড চুরি করে একাউন্ট দখলই এই কাজটার উদ্দেশ্য।
কীভাবে এড়াবেন? -- খুব সহজ। যে কেউ ইমেইল করে "আমি ফেইসবুকের সিকিউরিটি টিম" বা "আমি ব্যাংকের লোক বলছি" বললেই বিশ্বাস করবেন না। ইমেইলের উপরে ক্লিক করলেই প্রেরকের নাম ধাম দেখা যায়। সেটা দেখুন ভালো করে। আসলেই কি এটা ব্যাংকের ডোমেইন থেকে এসেছে? আর কোনো লিংকে ক্লিক করার আগে সেটার উপরে মাউজ পয়েন্টার রেখে দেখুন আসলেই এটা ব্যাংকের বা আপনার পরিচিত সাইটের ডোমেইন থেকে দেয়া লিংক কি না। ক্লিক করে ফেলেই যদি থাকেন, তাহলে চেহারা দেখে ভুলবেন না, বরং উপরে এড্রেস বারে আসল সাইটের ঠিকানা দেখা যাচ্ছে কি না, ভালো করে খেয়াল করুন।
ফিশিং বর্তমান সাইবার ক্রাইম জগতে বহু ব্যবহৃত একটি কায়দা। আমি সবসময়ে যেটা বলি তা হলো সিকিউরিটি একটি মানবীয় সমস্যা -- ফিশিং তার খুব যথার্থ উদাহরণ। কারিগরি কায়দার বদলে এখানে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মানে কাউকে ধোঁকা দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়াই মুখ্য। একটু সচেতন থাকলেই ফিশিং থেকে বাঁচতে পারেন। আর রক্ষা করতে পারেন আপনার একাউন্ট, ব্যক্তিগত তথ্য, কিংবা ব্যাংকে রক্ষিত টাকা পয়সা।
ব়্যানসমওয়্যার
উন্নত বিশ্বে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে৷ অপরাধীরা ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে অন্যের কম্পিউটারের ফাইলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়৷ তারপর ঐ কম্পিউটার ব্যবহারকারীকে বার্তা পাঠায় এই বলে যে, ফাইল ফেরত পেতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হবে৷
র্যান্সমওয়ার (Ransomware) -- এক ভয়াল সাইবারআতঙ্ক -- আসছে ধেয়ে !! ~
বেশ আরামেই ছিলেন। এখানে ওখানে লাইক দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। কেউ কোনো লিংক পাঠালে হামলে পড়ে ক্লিক করে নিচ্ছিলেন মজা। ইমেইলে হোক বা মেসেঞ্জারে, কতো কিছু দেখার আছে, যাই পান, তাই ক্লিকান, শেয়ারান, লাইকান। কী আরামের জীবন, তাই না?
হঠাৎ করে আপনার কম্পিউটারের সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে এলো। স্ক্রিনে একটা উইন্ডো ওপেন হয়ে গেলো। সেখানে কাউন্ট ডাউন হচ্ছে। আর আছে বার্তা। আপনার জন্যই একটা বার্তা।
"এই কম্পিউটারের সব ফাইল এখন আমাদের দখলে। সবগুলা ফাইল এনক্রিপ্ট করে দুর্বোধ্য করে দেয়া হয়েছে। যদি পেতে চাও, তাহলে জলদি জলদি ১ সপ্তাহের মধ্যে আমাদের ঠিকানায় বিট কয়েনের মাধ্যমে ৫০০ ডলার পাঠাও। তাহলে তোমার ফাইল ফেরত পাওয়ার গুপ্ত চাবি বা key দেয়া হবে।
তোমার সময় সীমিত। আর পুলিশকে বলে কিচ্ছু হবে না, তারা কিচ্ছু করতে পারবেনা, কিন্তু ১ সপ্তাহ পেরুলে তোমার সাধের সেলফি, দরকারি ডকুমেন্ট, কিছুই আর কোনোদিন ফেরত পাবে না"।
ঘাবড়ে গিয়ে জলদি জলদি আপনার ফটো ফোল্ডারে গেলেন, আসলেই তো, কিছুই তো নাই। মানে আছে বটে, কিন্তু প্রত্যেকটা ফাইলের এক্সটেনশন পাল্টে গেছে, আর রিনেম করে খোলার চেষ্টা করেও খুলতে পারছেন না। আপনার ডকুমেন্ট ফোল্ডারেরও একই অবস্থা। কিছুই পড়া যাচ্ছেনা, সব দুর্বোধ্য।
ঘটনাটা কী? ঘটনা হলো আপনি শিকার হয়েছেন র্যান্সমওয়ার নামের নতুন ধরনের ভাইরাসের।
এক কালে ভাইরাস কিছুই করতো না, স্ক্রিনে হাবিজাবি মেসেজ দিতো, আর বেশি খাইস্টা হলে ফাইলের মধ্যে ঢুকে বসে থাকতো। কিন্তু সে ছিলো সাইবারক্রাইমের প্রাথমিক আমল। ভাইরাস লিখতো বোরড হয়ে যাওয়া টিনেজ বয়সী ছেলেপেলেরা। সেই আমল আর নাই, এখন প্রকৃত অপরাধীরা নেমেছে মাঠে। তাদের লক্ষ্য চাঁদাবাজি, আপনার জিনিষপত্রকে জিম্মি করে রেখে টাকা আদায়। মজার ভিডিও দেখার লোভে নানান লিংকে ক্লিক করে আপনি দিব্যি তাদের টোপ গিলছেন, আর তাদের রানসমওয়ার ভাইরাস ঢুকে গেছে আপনার কম্পিউটারে। একবার ঢোকার পর এর কাজ হলো কম্পিউটারের সব ফাইলকে এনক্রিপ্ট করে ফেলা বা দুর্বোধ্য করে দেয়া। সেই সব ফাইল আগের অবস্থায় পেতে হলে একটি জটিল সংকেত বা key লাগবে, যা আন্দাজে বের করা সম্ভব না কারো পক্ষে, কেবল অপরাধীদের কাছেই আছে সেটা। ব্যাস, এটা একবার করে ফেলার পরেই আপনাকে দেয়া হবে সেই চাঁদা চেয়ে চিঠি। দুঃখজনক হলো, অন্যান্য ভাইরাস নাহয় এন্টিভাইরাস দিয়ে সরানো সম্ভব, কিন্তু রানসমওয়ারে এনক্রিপ্ট বা দুর্বোধ্য হওয়া ফাইল কোনোভাবেই ফেরত পাবেন না, যদি না আপনার কাছে সেই সাংকেতিক চাবি বা key থাকে।
ফলে আপনি নাচার, এই অপরাধীদের টাকা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। আর এরা টাকাটাও নেয় ডিজিটাল কারেন্সি বিট কয়েনে, যা কোনোভাবেই ট্রেস করা যায় না কে কীভাবে নিয়ে গেছে। টাকা দিতে না পারলে ১ সপ্তাহ পরে তাদের চাহিদা আরো বাড়বে, এবং আর কিছুদিন পরে চিরতরে আপনার ফাইলগুলা হারাবেন।
এই সমস্যা রীতিমত মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, এবং এর সহজ কোনো সমাধান নাই। আমেরিকার এক হাসপাতালের সব ফাইল, রোগীর তথ্য কিছুদিন আগে গায়েব হয়ে গেছে এইভাবে, তারা হাজার হাজার ডলার দিয়ে ফেরত পেয়েছে। আরেক জায়গায় বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার মতো এক পুলিশ বিভাগের সব রেকর্ড এভাবে অপরাধীরা জিম্মি করে রেখেছিলো, পুলিশ শেষ পর্যন্ত ৮ হাজার ডলার দিয়ে ফেরত পেয়েছে তাদের ফাইল। সাধারন ইউজারেরা ৩০০ থেকে ৫০০ ডলার দিয়ে তবেই ছাড়া পাচ্ছেন। আর এই পুরা জিনিষটা নিয়ন্ত্রন হচ্ছে পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া, এবং অজানা জায়গার সব অপরাধী মাস্টারমাইন্ডদের হাতে।
বাংলাদেশে রান্সমওয়ার কতটা ছড়িয়েছে জানি না, কিন্তু অচিরেই এটা বাংলাদেশে বড় একটি সাইবারক্রাইম হিসাবে দেখা দিবে বলে আশংকা করছি। কাজেই সময় থাকতে সাবধান হন, নিজের ছবি, ফাইলের ব্যাকাপ রাখুন পেন ড্রাইভে বা ইন্টারনেটের সাথে সংযোগ নাই এমন জায়গায়, আর এখানে সেখানে ক্লিকানো, লাইকানোর বদভ্যাসটা বাদ দেন।
রান্সমওয়ার আইলো ... সবাই সাবধান ..
সাইবার মবিং বা সাইবারবুলিং
হয়ত মজা করার জন্য কিংবা ইচ্ছে করে একজনকে কষ্ট দিতে তার বন্ধুরা একজোট হয়ে হয়রানি করে থাকে৷ বাস্তবে স্কুল-কলেজে এমনটা হয়ে থাকে৷ আজকাল ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে ওঠায় ভার্চুয়াল জগতে এমন ঘটনা ঘটছে৷ কিন্তু অনেক সময় বিষয়টি আর মজার পর্যায়ে না থেকে ভয়ানক হয়ে ওঠে৷ ফলে যাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে সে হয়ত এমন কিছু করে ফেলে যা কারও কাম্য থাকে না৷
ম্যালভার্টাইজিং
ধরুন আপনি কোনো ওয়েবসাইটে আছেন৷ সেখানে একটি বিজ্ঞাপন দেখে ক্লিক করলেন৷ ব্যস আপনার কম্পিউটারে একটি কোড ডাউনলোড হয়ে গেল৷ এটি কোনো নিরীহ কোড নয়৷ অপরাধীরা এর মাধ্যমে আপনাকে হয়রানির পরিকল্পনা করবে৷ সুতরাং...সাবধান ৷
ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড স্কিমিং
রেস্টুরেন্ট, সুপারমার্কেটের বিল পরিশোধ, এটিএম থেকে টাকা তোলা, অর্থাৎ এমন কোথাও যেখানে আপনার ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডকে যন্ত্রের মধ্যে ঢোকাতে হয় সেখান থেকেও তথ্য চুরি হতে পারে৷ এটাই কার্ড স্কিমিং৷ স্কিমার যন্ত্রের মাধ্যমে এই তথ্য চুরি করা হয় বলে এর এমন নামকরণ হয়েছে৷
সাইবারক্রাইম -- ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড স্কিমিং কী এবং কীভাবে রক্ষা পাবেন ?
ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড নিয়ে ঘুরছেন? এটিএম থেকে আরামে টাকা তুলছেন? কিংবা দোকানে খেয়ে দেয়ে বা জিনিষ কিনে কার্ডে দাম দিচ্ছেন? সাবধান!!! অভিনব কায়দায় আপনার কার্ড এবং টাকা পয়সা লোপাট করতে মাঠে নেমেছে সাইবারক্রিমিনালেরা!! এবং বাংলাদেশেও তারা হাজির। সাবধান!!
বাংলাদেশে সাইবারক্রাইম খুব জোরেসোরে শুরু হবে, বছর দুয়েক আগে ভবিষ্যতবাণী করেছিলাম। এটাও বলেছিলাম যে, সরকারী নানা সংস্থা এসব সাইবারক্রাইমের ব্যাপারে একেবারেই প্রস্তুত না। এমনকি সরকারী পর্যায়ে ওয়েবসাইট ডিফেস করা ছিঁচকে লোকজনকে ধন্য ধন্য করা হয়, আর অন্য দিকে ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়।
আমার আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে সম্প্রতি দেশে ডেবিট কার্ড স্কিমিং জালিয়াতির বড় বেশ কিছু ঘটনা শুরু হয়েছে। এবং এক বিদেশী বাটপার ধরা পড়লেও শান্তিতে থাকার কিছু নাই। এভাবে সহজে পয়সা কামানো যায় সেই ব্যাপারটা আরো অনেক চোট্টাবাটপারের নজরে এসে গেছে, কাজেই এই ঘটনা ঘটবেই।
তো, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড স্কিমিং কাকে বলে? আসুন দেখা যাক।
ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের পিছনে একটা ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ থাকে কালো বা খয়েরি রঙের। সেখানে কার্ডের নম্বর থেকে শুরু করে অন্যান্য তথ্য ভরা থাকে। আপনি যখন এটিএম এ কার্ড ঢোকান কিংবা দোকানে সোয়াইপ করেন, তখন কার্ড রিডার সেই স্ট্রিপ থেকে কার্ডের তথ্য পায়। এই তথ্যটুকু যদি কারো হাতে চলে যায়, সে কিন্তু চাইলেই আপনার কার্ডের একটা ক্লোন বা কপি বানিয়ে ফেলতে পারবে, তার পর সেটা দিয়ে আপনার ব্যাংক একাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ডে চার্জ করতে পারবে। অপরাধীরা এই সুযোগটাই নেয়। এটিএম এর কার্ড ঢোকানোর জায়গাটায় তারা অতিরিক্ত একটা যন্ত্রাংশ লাগিয়ে দেয়। সেটার কাজ হলো কার্ড ঢোকার সময়ে মেশিনে ঢোকার আগে আগে কার্ডের ম্যাগনেটিক স্ট্রিপটা পড়ে নেয়া, আর সেই তথ্য অপরাধীর কাছে পাঠানো। এই যন্ত্রটাকে বলা হয় স্কিমার (skimmer)। আবার অনেক সময়ে পোর্টেবল স্কিমার পাওয়া যায়। রেস্টুরেন্টে খেয়ে ওয়েটারের হাতে কার্ড দিলে আড়ালে গিয়ে এক সেকেণ্ডের মধ্যেই কিন্তু আপনার কার্ড স্কিমার দিয়ে কপি করে নিতে পারে। এর পর কার্ডের তথ্যগুলাকে ব্ল্যাংক একটা কার্ডে ঢোকানো হয়, ফলে সেটা কার্যত আপনার কার্ডের কপি হয়ে যায়।
ডেবিট কার্ডের ক্ষেত্রে পিন সংখ্যাটি পেতে হলে আরেক ধাপ বেশি করতে হয়, অনেক সময়ে এটিএম এর কীবোর্ডের উপরে আলগা নকল কীবোর্ড লাগানো হয়। অথবা কীবোর্ডের জায়গাটা দেখা যায় এভাবে একটা গোপন ক্যামেরা বসিয়ে যায় অপরাধীরা। সেভাবেই আপনার পিন সংখ্যাটি পড়ে ফেলতে পারে।
স্কিমিং এর বাটপারিটা পশ্চিমা দুনিয়াতে বহুদিন ধরেই হয়ে আসছে। আপনি একটু সাবধান থাকলে এটা এড়াতে পারেন। যেমন --
- এটিএম বুথে কার্ড ঢোকাবার আগে দেখে নেন, কার্ড ঢোকানোর জায়গাটা কি আলগা বা আলাদা লাগছে নাকি। সেটা কি অস্বাভাবিক বা বেঢপ ধরনের, মনে হচ্ছে কি এটা পরে লাগানো হয়েছে? দরকার হলে হালকা টান দিয়ে দেখেন ঐটা আলগা নাকি।
- পিন এন্টার করার সময়ে কীবোর্ডটা আলগা নাকি দেখে নেন।
- পিন এন্টার করার সময়ে কোন কী চাপছেন সেটা অন্য হাত দিয়ে ঢেকে রাখেন।
- রেস্টুরেন্টে বা অন্যত্র ওয়েটারের হাতে নিশ্চিন্তে কার্ড দিয়ে ফেলবেন না। সম্ভব হলে কাউন্টারে গিয়ে নিজের চোখের সামনে থাকা অবস্থায় বিল দেন। রেস্টুরেন্ট যত নামিদামিই হোক না কেনো, বিশ্বাস করবেন না। (আমি ভুক্তভোগী। আমেরিকার এক নামকরা জায়গায় রেস্টুরেন্টের ওয়েটার আমার ক্রেডিট কার্ড কপি করে নিয়েছিলো। ভাগ্য ভালো ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি সন্দেহজনক চার্জ দেখে আমাকে ফোন করেছিলো।)
স্কিমিং এখন বেশ লো-টেক সাইবারক্রাইম। তবে বাংলাদেশে এটা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষসহ কারো ধারণা নাই বলে পিটার নামের ঐ বিদেশী প্রতারক তার সুযোগ নিয়েছে। এবার নামবে মাঠে দেশি প্রতারকেরাও। কাজেই সময় থাকতে সাবধান হন।
ফোন ফ্রড
অচেনা কোনো নম্বর থেকে (বিশেষ করে বিদেশ থেকে) মিসড কল পেলে সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক না করাই ভালো৷ কারণ কে জানে হয়ত ফোন ফ্রড অপরাধীরা এই কলটি করেছিলেন৷ আর আপনি কলব্যাক করতে যে টাকা খরচ করলেন তার একটি অংশ পেয়ে গেল অপরাধীরা!
ইন্টারনেট প্রতারণা ও সাইবারক্রাইমের অনেক আগে থেকেই চলে আসছে প্রাসঙ্গিক আরেকটি প্রতারণা - ফোন ফ্রড। ল্যান্ডলাইনের পাশাপাশি এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে মোবাইল ফোনের জগতেও। এই ফোন ফ্রডের উপরে সম্প্রতি বাংলাদেশের নানা পত্রপত্রিকায় খবর ছাপা হচ্ছে, তাই এই ফোন ফ্রডের কিছু ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করতে চাই। ফোন ফ্রড অনেকভাবেই হতে পারে, সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং তো আছেই, যেখানে ফোন করে আপনি লটারি জিতেছেন, বড় অংকের টাকা পেতে এখানে কিছু ফি দেন, এরকম তো আছেই। সেটা নিয়ে হয়েছে অনেক আলোচনা, কিন্তু অন্য রকমের ফোন ফ্রড সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। এরকম ফোন ফ্রডের মধ্যে 809 scam বা Wangiri scam বেশ চালু সারা বিশ্বে, সম্প্রতি বাংলাদেশেও এটা ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা বোঝার আগে ফোন সিস্টেমের বিলিং চার্জ কীভাবে হয়, তা একটু ব্যাখ্যা করি। অনেক ফোন কোম্পানিই প্রিমিয়াম নাম্বার রাখে, যেখানে ফোন করলে নর্মাল চার্জের পাশাপাশি মিনিট প্রতি সার্ভিস চার্জ দেয়া লাগে ঐ নম্বরের মালিককে। আর আন্তর্জাতিক কলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো গোলমেলে। ধরুন আপনি গ্রামীণফোন থেকে কল করলেন বিদেশের কোনো নম্বরে। সেখানে ফোন করার জন্য গ্রামীণ আপনাকে যা বিল করবে, তার একটা অংশ পাবে যেই নম্বরে ফোন গেছে, সেই ফোন কোম্পানী। আর যদি ঐ নম্বরটা প্রিমিয়াম নম্বর হয়, তাহলে তো কথাই নাই, ফোন নম্বরের মালিক ইচ্ছামত যা চার্জ করে, গ্রামীণ আপনাকেও সেই চার্জ করবে। আর পুরা ব্যাপারটা আইনমোতাবেকই হচ্ছে। এখন এই সিস্টেমটাকে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রতারক নতুন ধান্ধা খুলে বসেছে। অসাধু ফোন কোম্পানির সহায়তায় তারা প্রিমিয়াম নম্বর খুলে বসে, তার পর অটোডায়ালার সফটওয়ার দিয়ে মিস কল দিতে থাকে অন্য দেশের নানা জায়গায়। যেহেতু কল করতে হচ্ছেনা, তাদের খরচ নাই আদৌ। আর সফটওয়ার দিয়ে অটো-ডায়াল করাতে দিনে হাজার হাজার এমন মিস কল দিতে পারে। এমন হাজারটা মিস কল দিলে কেউ না কেউ আগ্রহ বশত কল রিটার্ন তো করবেই, তাই না? ব্যস। এরা পেয়ে বসলো। আন্তর্জাতিক কলের জন্য আপনাকে তো দিতে হবে রেট অনুযায়ী চার্জ, তার উপরে সেই প্রিমিয়াম নম্বর এর ধান্ধাবাজ মালিক যা রেট ধরে রেখেছে, আপনাকে সেটাও দিতে হবে। বলাই বাহুল্য, সেই চার্জটা আকাশ ছোঁয়া। এই ব্যাপারটার উদ্ভব ঘটে জাপানে, সেখানে এই প্রতারণা পদ্ধতির নাম Wangiri। তবে এখন নানা গরীব দেশ যেমন আফ্রিকা বা ক্যারিবিয়ানের দেশে এই প্রতারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশেও সম্প্রতি অনেকে এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে পড়লাম। তাই সাধু সাবধান, অচেনা বিদেশী নম্বর থেকে মিস কল পেলে রিটার্ন কল দিবেন না কখনোই।
পোষ্টটি লিখেছেন : কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. রাগিব হাসান" Ragib Hasan (Assistant Professor at University of Alabama at Birmingham)