‘মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়’ মত বিনিময় সভা।
শিক্ষাবিদদের পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, সহজপাঠ্য বই তৈরির বিষয়ে আমারা কাজ করছি। সৃজনশীলকে আরো চমৎকার করার ক্ষেত্রে আপনাদের মূল্যবান মতামত আমাদের সাহায্য করবে। আমরাও চেয়েছি এমসিকিউ বন্ধ করতে, আপনাদের পরামর্শে সে কাজটি আরো ত্বরান্বিত হবে। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার ‘মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় শিক্ষাবিদরা এই পরামর্শ দেন। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ সভার আয়োজন করা হয়।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন, অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী প্রমুখ।
ড. ফরাস উদ্দিন বলেন, এমসিকিউ পদ্ধতি শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনা উচিৎ। কওমি মাদ্রাসার মূল কারিকুলাম ঠিক রেখে সরকারি অর্থায়নে তাদের আধুনিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রতি জোর দেন তিনি। তিনি বলেন, পিইসি, জেএসসি কোচিং, গাইড বই বাণিজ্যের উৎস। গাইড বই, না টেক্সট বই- এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলে কার্যকর করতে হবে। গাইড বই নীতিমালাকে চুরির পথ আখ্যায়িত করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, পাঠদানের ক্ষেত্রে বেসিক বিষয়গুলো যুক্ত করে বাড়তি বিষয় বাদ দেওয়া উচিৎ। কারণ বাড়তি বিষয় শেখানোর জন্য এখন আইসিটিতে আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। এ জন্য বই ভারি করার প্রয়োজন নেই।
ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন, নিয়ম হচ্ছে তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্কুল হতে পারবে না। এখন তিন কিলোমিটারের মধ্যে হাজার হাজার স্কুল হচ্ছে, এমপিও পাচ্ছে। অথচ সারাদেশে ৫৩টি স্কুলের কেউ এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাসই করতে পারেনি।
শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিয়ে তিনি বলেন, দেশে ৩৩৮টি সরকারি স্কুল আছে। বেসরকারি স্কুল আছে ১৯ হাজার। স্কুলগুলো যখন এমপিওভুক্ত হয়, তখন ৯০ শতাংশ বেতন সরকার দেয়। ১০ শতাংশ বেতন দেয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি হলে সরকার ১০০ শতাংশ বেতন দেয়। সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ১০ শতাংশ বেতনও পান শিক্ষকরা। এসব প্রক্রিয়ায় যে প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি হয়, সেই স্কুলের শিক্ষকরা ১১০ শতাংশ বেতন পান। এ বিষয়গুলো সরকারের ভেবে দেখা উচিত।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, পাঠ্যবই সহজবোধ্য হওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে। শিক্ষকরা না পড়ালেও নিজে নিজে পড়ে যেন তারা বুঝতে পারে। আমাদের বই লেখার পদ্ধতি ভালো না। নবম শ্রেণির বিজ্ঞানের বই আমি নিজে বুঝে উঠতে পারিনি, বাচ্চারা কীভাবে বুঝবে। বই যত্ন নিয়ে তৈরি করতে হবে। ভালোভাবে বই ছাপলে এক বই ৭/৮ বছর ধরে পড়ানো যায়।
বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ বলেন, শিক্ষার তিনটি ভিত্তি হলো- শিক্ষক, বই এবং পরীক্ষা। শিক্ষকের বিষয়টি নিয়ে আমি কিছু বলব না। কারণ এ দিক দিয়ে আমরা খুবই দুর্বল। জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হলে ভালো শিক্ষক পাওয়া সম্ভব হবে। এমসিকিউ প্রসঙ্গে তিনি একবাক্যে বলেন, এমসিকিউ তুলে দেওয়া উচিৎ। এর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ধরনের গ্রেডিং পদ্ধতি অবলম্বনের কথা বলেন তিনি।
খবরের কাগজে প্রতিদিন গাইড ছাপানো হচ্ছে অভিযোগ তুলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, প্রতিদিন পত্রিকাগুলো গাইড ছাপাচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। তাহলে আমরা যাবো কোথায়।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, অনেক শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন না। সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে তারা বুঝে উঠেন না, কোন পদ্ধতিতে পাঠদান করবেন। যার ফলে তারা ঝুঁকছেন গাইড বইয়ের দিকে। অভিভাবক ছুটছেন কোচিং সেন্টারের দিকে। প্রাইভেট টিউটরের দিকে।
সব শিক্ষক ভালো বুঝবেন, পড়াবেন, প্রশ্ন করবেন- এটা সম্ভব না উল্লেখ করে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, এ সমস্যা সমাধানে সেন্ট্রাল কোয়েশ্চেন ব্যাংক তৈরি করা যেতে পারে। যেখানে অসংখ্য প্রশ্ন থাকবে। শিক্ষকরা সৃজনশীলতাকে বুঝতে পারবেন। পড়াতে পারবেন। প্রশ্নও করতে পারবেন। এবং এ প্রশ্ন ব্যাংক থেকেই পরীক্ষায় প্রশ্ন আসবে। শিক্ষর্থীরা দিকনির্দেশনা পাবে। অভিভাবকের ছুটাছুটি বন্ধ হবে।
তিনি বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলা স্কুলে পড়াশোনা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এর মূল কারণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। অন্যদিকে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত ক্যাডেট স্কুলগুলো বাইরের প্রভাবমুক্ত থাকায় তারা এগিয়ে যাচ্ছে।এমসিকিউ প্রশ্নের ফলে নকল হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমসিকিউ ১৫ তে নামিয়ে আনতে হবে। এক বাক্যে প্রশ্ন করার ফলে নকলেরর প্রবণতা বেশি বাড়ছে। এ নকল ঠেকাতে দুই বা তিন বাক্যের প্রশ্ন করতে হবে। এমসিকিউ বাদ দেওয়া গেলে আরো ভালো হয়। শিক্ষাবিদ আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, এখন দেখা যায় যেই পরীক্ষা দিচ্ছে, সেই পাস করার ফলে পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে জনমনে অনাস্থা দেখা দিয়েছে। সাধারণের প্রশ্ন সবাই পাস করলে পরীক্ষা নেওয়ার কী দরকার?
নারী শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি এবং শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীদের মারধর বন্ধে নেওয়া নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগের উপর জোর দেন রাশেদা কে চৌধুরী। প্রয়োজনে নীতিমালাগুলো প্রত্যেকটি স্কুলে টাঙানো উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সহজবোধ্য পাঠ্যবই তৈরির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। সৃজনশীলকে আরো চমৎকার করা ক্ষেত্রে আপনাদের মূল্যবান মতামত সাহায্য করবে। আমরাও চেয়েছি মাধ্যমিক পর্যায়ে এমসিকিউ বন্ধ করতে, আপনাদের পরামর্শে সেই কাজটি আরো ত্বরান্বিত হবে। প্রশ্ন ব্যাংকের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে আরো আলোচনা সাপেক্ষে প্রস্তাবটি ভেবে দেখা হবে।