লাইভ ভিডিও টেলিভিশনের জায়গা দখল করবে।
খুব সম্প্রতি আমি গুগল প্লে স্টোর থেকে একটি মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করেছি, যার নাম আড্ডা। আমার অতি পরিচিত তারেক সুজাতের প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করেছে। এই অ্যাপটি দিয়ে আমি বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, একাত্তর, দেশ ও চ্যানেল আই দেখি ইন্টারনেটে। এর সঙ্গে ভারতের দুটি ও অন্য দুটি টিভিও দেখতে পারি। কোনো চার্জও আমাকে দিতে হয় না। ব্যয় বলতে ইন্টারনেটের ডাটার জন্য যা খরচ করতে হয় তাই।
এর ফলে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, টিভি দেখার জন্য আমাদের এখন আর টিভি সেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। বরং এটি টিভি থেকে মোবাইল ফোনে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আরো একটি বিষয় চোখে পড়ার মতো যে মোবাইল অপারেটররা টিভি সেবা প্রদান করা শুরু করেছে। মোবাইলে যখন বিনামূল্যে কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে তখন কথা বলার মোবাইল নেটওয়ার্কের জন্য এমন পথে চলা শুরু করাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। মোবাইল যন্ত্রটি রেডিও শোনার, ছবি তোলার যন্ত্র হয়েই আছে। ইন্টারনেট ব্রাউজ করা ও নানাবিধ কাজে একে ব্যবহার করার এক অসাধারণ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে এই যন্ত্রটির। ফলে ডিজিটাল সভ্যতার ডিজিটাল যন্ত্র বলতে আমরা সবচেয়ে জনপ্রিয় হিসেবে মোবাইলকেই শনাক্ত করতে পারি। মোবাইলের আকার কেমন হবে, এটি অ্যাপলের আইফোন থাকবে, না স্যামসাঙের গ্যালাক্সি হবে, না ট্যাবলেট হবে এসব নিয়ে অনেক লম্বা বিতর্ক হতে থাকবে। কেউ ট্যাবলেটকে ল্যাপটপের বিকল্প বানাবেন, কেউ স্মার্ট ফোনকে ট্যাবলেটের বিকল্প বানাবেন।
তবে সম্ভবত কিছু মৌলিক বিষয় এমন হবে যে, স্মার্ট ফোন ও ট্যাবলেটে (হয়তো ল্যাপটপেও) সিম ব্যবহারের সুযোগ একটি অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। ওয়াইফাই-ব্লুটুথ নিয়ে কথা বলার দরকারই নেই। ঘটনাটি সম্ভবত কেবল মোবাইলে টিভি দেখাতেই সীমিত হয়নি।
বাংলাদেশে যারা টিভি দেখেন তারা টিভি কেন্দ্রগুলোর স্ক্রলবারে দেখেন যে র্যাডিয়েন্ট আইপি টিভি নামের একটি অ্যাপ দিয়ে ইন্টারনেট থেকেও টিভি দেখা যায়। এর মানেটি খুবই সহজ। আপনি ইন্টারনেটে যুক্ত থাকলেই টিভি আপনার হাতের মুঠোয়। ইদানীং ইন্টারনেটভিত্তিক টিভি পাওয়া যায়। ফলে টিভি সেটেও ইন্টারনেটের টিভি পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বেশকিছু টিভি কেন্দ্র নিজস্ব অ্যাপ বাজারে ছেড়েছে। সেটি দিয়েও সেই টিভির পর্দা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। একই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে আমি কথা বলছিলাম কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। ওরা বাংলাদেশে বসে অ্যাফিলিয়েটেড মার্কেটিং করেন। ওদের ব্যবসার খবর জানতে গিয়ে বোঝা গেল যে, ওরা প্রধানত আমেরিকার টিভি দর্শকদের জন্য খেলার বিষয়গুলোর মার্কেটিং করে। আমেরিকান টিভি চ্যানেলগুলোর স্ট্রিমিং ভিডিও ইন্টারনেটের বিভন্ন সাইটে টাকার বিনিময়ে সম্প্রচার করা তাদের ব্যবসা। তাদের মতে, আমেরিকানরা আমাদের মতো ডিশ লাইনে বা সেটটপ বক্সে টিভি দেখা অ্যাফোর্ড করতে পারে না। ওদের জন্য সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। যারা সাম্প্রতিককালের খবরাখবর রাখেন তারা জানেন যে, এখন সরাসরি ইন্টারনেটে টিভি সম্প্রচার করতে প্রযুক্তিগত কোনো সমস্যাই নেই। আমি নিজে অনেকগুলো ইন্টারনেট টিভি প্রতিষ্ঠানের ফিতে কেটেছি। আরো আধা ডজন টিভি কেন্দ্র ইন্টারনেট টিভি হিসেবে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় আছে। অন্যদিকে প্রচলিত টিভিগুলোকেও সরাসরি অনলাইন সম্প্রচারের পথে পা রাখতে হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইন্টারনেটে সম্প্রচারিত টিভি দেখার জন্য টিভি সেটের কথা ভাবার দরকার নেই, যদিও আজকালের টিভিগুলো ইন্টারনেট কম্পাটিবল হয়েছে। মোবাইল থেকে পিসি যাই হাতের কাছে যা মানুষকে ইন্টারনেটে যুক্ত করে সেটিই তার টিভি সেট। একই সঙ্গে কোথায় স্যাটেলাইট আছে, কোথায় তরঙ্গ পেলাম বা পেলাম না সেসব ভাবনার চেয়ে বড় ভাবনা হলো ইন্টারনেট সংযোগ আছে কিনা। বাংলাদেশের প্রেক্ষিত যদি ভাবেন তবে এটি মনে রাখতে হবে যে ২০০৮ সালে যেখানে মাত্র ১২ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ২০১৬ সালে সেটি ৬ কোটির ওপরে উঠেছে। আগামী পাঁচ বছরে সম্ভবত জনসংখ্যার এমন কেউ থাকবে না যার নাগালের মাঝে ইন্টারনেট থাকবে না। বাংলাদেশে যারা এখনো প্রচলিত টিভি মাধ্যমের লাইসেন্স নিয়ে মারামারি করছেন তারা হয়তো এই রূপান্তরটি অনুভব করতে পারছেন না।
অন্যদিকে যারা ইন্টারনেট টিভির পাশাপাশি স্যাটেলাইটেও টিভি সম্প্রচার করতে চান তাদের এখন আর ভূউপগ্রহ কেন্দ্র বা ফ্রিকুয়েন্সি বা তরঙ্গ বরাদ্দ নেয়ার দরকার নেই। ইন্টারনেট সেই কাজটিও করে ফেলেছে। আপনি আপনার ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্যাটেলাইটে সম্প্রচারের উপাত্ত পাঠিয়ে দিতে পারেন। দুনিয়ার যে কোনো প্রান্ত থেকে সেটি স্যাটেলাইটে উঠে যেতে পারে। আমরা ক্রমান্বয়ে দুনিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মাধ্যমটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আমরা একটু ব্যাখ্যা করে দেখতে চাই যে, প্রচলিত টিভি বা সম্প্রচার ব্যবস্থা পুরোই কি রূপান্তরিত হবে। ইদানীং এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে যে ফেসবুক বা ইউটিউব টিভিকে বিলুপ্ত করে দেবে বা টিভির জায়গা দখল করবে। যে টিভি নিজে কাউকে বিলুপ্ত করতে পারেনি সে অন্যের হাতে বিলুপ্ত হবে? অনুষঙ্গটি বড়ই জটিল। অনেকেই হয়তো লক্ষ করে থাকবেন যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক যখনই কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বা সেই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কেউ বক্তব্য রাখেন তখন তিনি তার মোবাইলটাকে সেলফি বা মাইক স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে তার বা বক্তার সামনে বসিয়ে রাখেন। কখনো তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা মোবাইলটিকে বক্তার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না ব্যাপারটা কি? কেউ কেউ ভাবেন ছবি তোলা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন এভাবে ভিডিও না করলে কি নয়। যারা জানেন তারা বোঝেন যে এটি কেবল ভিডিও করা নয়। পলক তার ফেসবুকে ভিডিওটিকে সরাসরি সম্প্রচার করেন। দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর মতো পেশাদারিত্ব না থাকলেও এর দর্শক সীমা হাজার হাজার বলে পলক নিজেই ঘোষণা করেন। এ রকম সুযোগ আমার এই নিবন্ধটি লেখার সময়কাল অবধি আর কেউ পান বলে আমার জানা নেই। পলকের ফেসবুক হিসাবের হিসাবটা পাওয়া গেলে বোঝা যাবে যে তার ফেসবুক লাইভ কত বড় একটি গণমাধ্যম। পলকের ৫ হাজারের মতো বন্ধু আছে। এর বেশি বন্ধু নেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। কিন্তু ৬ মে ২০১৬ তার অনুসরণকারী ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৫৬ জন। একটু ভেবে বলুন আমাদের প্রচলিত গণমাধ্যমের কয়টি পলকের সমপরিমাণ দর্শকের কাছে পৌঁছানোর সক্ষমতা রাখেন। যারা পলকের মতো তারা নিজেরাই যে এক একটি অত্যন্ত শক্তিশালী গণমাধ্যমে পরিণত হচ্ছেন সেই বিষয়টি আমাদের ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। ফেসবুক লাইভ এখন বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এই সম্পর্কে মিডিয়ার খবর হচ্ছে এরকম :
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের লাইভ ভিডিও সম্পর্কে মাধ্যমটির সিংহভাগ ব্যবহারকারী অল্প-বিস্তর অবগত। ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ প্রায়ই বিভিন্ন লাইভ ভিডিও পোস্ট করে থাকেন। জাকারবার্গের পাশাপাশি আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই ফিচারটি ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ফিচারটি ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
ফিচারটি এখনো পর্যন্ত অল্প কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কয়েকদিন আগে ফেসবুক ঘোষণা দিয়েছিল এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাড়তি সুবিধা সংযোজনের জন্য আপাতত ফেসবুকের গবেষণাগারেই রয়েছে এটি।
কিন্তু কতদিন এই প্রযুক্তি জাকারবার্গের ঘরে থাকবে? কোনো নিশ্চয়তা নেই যে কাল সকালেই সবার জন্য এটি উন্মুক্ত হবে না। যারা টিভির দিকে নজর রাখেন তারা জানেন যে এখনকার টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য সরাসরি সম্প্রচার কোনো ব্যাপারই না। এক সময়ে বিশালাকারের ওবি ভ্যান নিয়ে গিয়ে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করতে হতো। এখন সম্প্রচারকরা একটি ভিডিও ক্যামেরার সঙ্গে ইন্টারনেট যুক্ত করে দিয়ে সরাসরি সম্প্রচার করে বসে থাকেন। অন্যদিকে স্কাইপের অহরহ ব্যবহার তো আছেই। যদিও আমাদের দেশে স্যাটেলাইট টিভি স্টেশনগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে তাদের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান তথাপি দেশের নতুন জোয়ারের নাম অনলাইন গণমাধ্যম বা আইপি টিভি।
টেকশহর ডট কম থেকে ২২ এপ্রিল ২০১৬ সংগ্রহ করা খবরটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফেসবুকের এই ফিচারটি গণমাধ্যমের গতিধারাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করবে। পাল্টে দেবে অনেক কিছু। মোদ্দা কথা, গণমাধ্যমের জন্য একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ফেসবুক লাইভ। ফেসবুক লাইভের প্রভাবের কারণে বিলুপ্তির পথে বসতে পারে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো।
ইন্টারনেটভিত্তিক মিডিয়া কোম্পানি বাজফিডের প্রেসিডেন্ট জন স্টেইনবার্গ ফেসবুকের লাইভ স্ট্রিমিংকে টেলিভিশনের জন্য বড় হুমকি হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাজফিডও ইন্টারনেটে লাইভ ভিডিও ভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করে। এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে সপ্তাহে পাঁচদিন অন্তত এক ঘণ্টা করে লাইভ ভিডিও সম্প্রচার করছে। এ বছরের শেষের দিকে লাইভ ভিডিও প্রচারের পরিমাণকে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টায় উন্নীত করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।
জন স্টেইনবার্গ বলেন, তিনি আরো বলেন, লাইভ ভিডিও টেলিভিশনের জায়গা দখল করবে। আমি মনে করি দীর্ঘ সময় জুড়ে এই লাইভ ভিডিও রাজত্ব করবে, যতদিন পর্যন্ত আরো উন্নত কোনো প্রযুক্তি না আসে।
ঢাকা, ২০ মে ২০১৬
মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলাম লেখক।