মারা গেলেন কিংবদন্তী বক্সার মোহাম্মদ আলি.
মারা গেলেন কিংবদন্তি বক্সার প্রাক্তন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলি। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। বেশ কয়েক দিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। এ ছাড়া বেশ কয়েক বছর ধরে দুরারোগ্য পার্কিনসন্স রোগে ভুগছিলেন আলি। শুক্রবার স্থানীয় সময়ে রাত দু’টো নাগাদ অ্যারিজোনার একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর।
আলির পরিবারের এক মুখপাত্র বলেন, “৩২ বছর ধরে এক অসম যুদ্ধ চালাচ্ছিলেন তিনি। শেষ তিন দিন তাঁর অবস্থার ক্রমেই অবনতি হচ্ছিল। শুক্রবার রাতে পার্কিনসন্সের কাছে হার মানেন তিন বারের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন।”
শেষ তিন দশক ধরে পার্কিনসন্সে ভুগছিলেন তিনি। রোগের প্রভাবে বেশ কিছু দিন কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন তিনি। হাঁটাচলার ক্ষমতাও হারিয়েছিলেন। কেনটাকিতে তাঁর বাড়িতে আলির শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে বলে জানা গিয়েছে।
স্বাস্থ্য খারাপ থাকলেও দেশীয় রাজনীতি নিয়ে যথেষ্ট উত্সাহ ছিল আলির। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঙ্কার দিয়েছিলেন, দেশে মুসলিমদের ঢুকতে দেওয়া হবে না। পাল্টা হুঙ্কার দিয়ে অসুস্থ আলি দেশের সমস্ত মুসলিমদের এক যোগে এর প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯৬০-এর প্রথম দিকে বিশ্বকে চমকে দিয়ে আবির্ভাব ঘটে বছর আঠারোর এই মার্কিন বক্সারের। সরকারের মুখের উপর যে বলতে পারে ভিয়েতনাম যুদ্ধে দেশের হয়ে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা। ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে হয়ে গেলেন মহম্মদ আলি। ১৯৬০ সালে অলিম্পিকে সোনা জিতে শুরু হয় তাঁর বর্ণময় কেরিয়ার। এর পর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। কেরিয়ারে মোট ৬১টি লড়াইয়ের মধ্যে ৫৬টিতেই জিতেছিলেন আলি। জো ফ্রেজারের সঙ্গে তাঁর লড়াইকে বলা হয় শতকের সেরা লড়াই। ১৯৭৫ সালের সেই ম্যাচ চসেছিল মোট ১৫ রাউন্ড। তিন বার বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ানশিপ খেতাব জিতে অবসর নেন তিনি।
তাঁর মেয়ে লায়লা আলিও একজন পেশাদার বক্সার।
বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চার হয়েছেন আলি।
যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যের সমালোচনায় মহম্মদ আলি এই মন্তব্য করেন :
‘স্বর্গ দেখতে চাইলে বাংলাদেশে যাও।’
৩৫ বছর আগে বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে মুগ্ধ হয়ে এ কথা বলেছিলেন বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের এই কিংবদন্তি। উল্লেখ করা যেতে পারে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নিমন্ত্রণে স্ত্রী ভেরোনিকাকে নিয়ে সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশ সফর করেছিলেন মোহাম্মদ আলী।
বিশ্বের অন্যতম সেরা এই মানুষটির বাংলাদেশ সফর সে সময় যেমন মোহাম্মদ আলীর জীবনে, তেমনি তাবৎ বাঙ্গালী হৃদয়ে একটা অন্যরকম ভালোলাগার ঝড় বইয়ে দিয়েছিলো। এমনিতে এই জীবন্ত কিংবদন্তীর প্রতি বাঙ্গালীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ছিলো অফুরন্ত, তার ওপর তাঁকে কাছে পেয়ে সেদিন সমগ্র জাতি আনন্দে ভেসেছিলো। সে সময় তাকে সম্মাননা হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
সম্প্রতি পুনঃপ্রকাশিত ১৯৭৮ সালের এক দুর্লভ ডকুমেন্টারি থেকে এসব তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। ‘Muhammad Ali Goes East: Bangladesh’ I Love You’ (মোহম্মদ আলীর পূর্ব সফর: বাংলাদেশ, তোমায় ভালোবাসি) নামে ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেছিলেন রেগিন্যাল্ড ম্যাসে।
মোহাম্মদ আলী যে সময় বাংলাদেশ সফর করেন, সেসময় সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের বয়স মাত্র ৭ বছর। অপরদিকে এই বিশ্ব বরেন্য তারকা তখন খ্যাতির শীর্ষে। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিওন স্পিঙ্কসের সঙ্গের বিখ্যাত ম্যাচে হারের পর হেভিওয়েট শিরোপা হাতছাড়া হয়ে যায় মোহাম্মদ আলীর। এরপরই ছুটি কাটাতে আসেন বাংলাদেশে।
ঢাকার বিমানবন্দরে মুহম্মদ আলীকে বরণ করতে হাজির হয়েছিলেন ২০ লাখেরও বেশি ভক্ত। অবস্থানকালে বাংলাদেশের বিখ্যাত স্থানগুলো স্ত্রীকে নিয়ে চষে বেড়ান তিনি। সুন্দরবন, সিলেটের চা বাগান, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, কক্সবাজার– কিছুই বাদ দেননি। তাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মাননা হিসেবে নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়া হয়। যার ফলে দেশত্যাগের আগে তিনি স্বগোতক্তি করেছিলেন- যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়া হয়, আমার আরেক ঘর আছে।
তখন কক্সবাজারে একখণ্ড জমিও উপহার দেওয়া হয় মোহম্মদ আলীকে। একটি স্টেডিয়াম তার নামে নামকরণ করা হয়। ডকুমেন্টারিতে বাংলাদেশে ফিরে এসে একটি বাড়ি বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘স্বর্গে যেতে চাইলে বাংলাদেশে আসুন।’
ঢাকা স্টেডিয়ামে ১২ বছর বয়সী এক বালকের সঙ্গে তিনি প্রীতি বক্সিং ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন। ছেলেটি অবশ্য তাকে নকআউটে হারিয়ে দিয়েছিল! বেশ উপভোগ করেছিলো সেদিন দর্শকরা এ অসম প্রীতি লড়াই।
শুধু বক্সিং রিংয়ে নয়, এর বাইরেও তার মানবিক গুণাবলীর কারনে তিনি ছিলেন আলোচনার শীর্ষে। তাকে বৈশ্বিক আইকন বলা হতো। তিনি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সুপরিচিত মুখ। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে তিনি তুমুল আলোড়ন তোলেন। কঙ্গো, ফিলিপাইনসহ সেসময়ের বিভিন্ন অনুন্নত দেশে তিনি বেশ কিছু বিখ্যাত ম্যাচ খেলেছিলেন।