top of page

নীরবে নিভৃতে থাকা একজন কিংবদন্তী লাকী আখন্দ এর গল্প -

চিরসবুজ বাংলা আধুনিক গানের কথা বলার আগেই বলতে হয় সুরকার ও সংগীত শিল্পী লাকী আখন্দের নাম।

আজ জনপ্রিয় এই সুরস্রষ্ঠার শুভ জন্মদিন। আজ এই শুভক্ষনে সারেগামা পরিবার বাংলা সঙ্গীতের কিংবদন্তী এই শিল্পীর জীবনের দীর্ঘায়ু কামনা করছে ।

শুভ হোক জন্মদিন এই প্রত্যাশায় একরাশ শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা রইল শিল্পীর প্রতি ।

সারেগামার পক্ষ থেকে লাকী আখন্দ এর প্রতি রইল জন্মদিনের শুভেচ্ছা।....

“১৯৯৮ এর এপ্রিল মাস নাগাদ আমি প্রথম বাংলাদেশ যাই, গান গাইতে। ঢাকার ন্যাশনাল মিউজিয়াম অডিটরিয়ামে আমাদের শো। প্রথমবার ঢাকা, হল ভর্তি শ্রোতা, দারুণ লাগছে। হঠাৎ শো’এর মাঝামাঝি আমাদের জলসার উদ্যক্তা নিমা রাহমান আমায় জানান, হলে একজন শিল্পী উপস্থিত, যিনি একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাকে আমি চিনিনা, তার গানও কখনও শুনিনি। কিন্তু একেবারেই নিছক আসর জমানোর উদ্দেশ্যে হঠাৎ তাকে মঞ্চে আসতে আহ্বান করলাম। তিনিও দিব্যি উঠে এলেন, এবং আমার সাথে গান বাজনা করতে শুরু করে দিলেন। যদিও তাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমার কোন গানটা গাইবো বলুনতো?’। তিনি বলেছিলেন, আমার গান তিনি আদৌ শুনেননি। দিব্যি গান গাওয়া হলো, আসর জমে গেল। বহু বছর যে শিল্পী গান গাওয়া বন্ধ করে চুপ মেরে বসেছিলেন হঠাৎ আবার গান গেয়ে উঠলেন। তারপর তার সঙ্গে তেমন ভাবে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু যে কারণে এইসব কথাগুলো বলছি, তা হলো- জীবনে খুব কমই আমি অন্য কোন শিল্পীর সঙ্গে গান গাইতে গিয়ে এতটা এনজয় করেছি। তাই ভাবলাম, গল্পটা আপনাদের বলি” প্রারম্ভিক পটভূমিতে যে গল্প রচিত হয়েছে সেটি আমার ভেবে ভুল করবেন না। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ, সৃষ্টিকর্তা যাকে মুগ্ধ হবার তীক্ষ্ণ ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। গল্পের পটভূমির সাথে হয়ত অনেকেই পরিচিত আছেন। সেই সংখ্যাটা অবশ্য খুব বেশী হবার কথা নয় ! আর যারা এখনও বুঝে উঠতে পারেন নি তাদের জন্য আরও কিছু গানের কথা সংযোজন করে দিলাম- “ দু’জনে থাকে দুটো দেশে দুজনেই গান বেচে খায় গানে গানে কোন এক মঞ্চে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় একজন বাজায় গীটার আরেকজন কীবোর্ডস একজন গান গেয়ে চলে আরেকজন দেয় সঙ্গ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় গান সেদিনের সেই জলসায় একাকার হয়ে যায় ঠিকানা কলকাতা কিংবা ঢাকায় . . .” বুদ্ধিমান শ্রোতা-পাঠক মাত্রই হয়ত চিনে ফেলেছেন দুই বাংলার দুই শিল্পীকে। কলকাতার সেই শিল্পীটি হলেন ‘অঞ্জন দত্ত’। আর ঢাকার সেই প্রিয় মানুষটি হলেন বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের এক দিকপাল ‘লাকী আখন্দ’। শিল্পী ‘অঞ্জন দত্ত’ তার ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ (১৯৯৯) অ্যালবামে কিংবদন্তী সঙ্গীতপরিচালক, সুরকার ও শিল্পী ‘লাকী আখন্দ’কে এভাবেই বন্দী করেন আবেগ-অনুভূতির সুর ও কথামালায়। ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ অ্যালবামে সংকলিত গানটির শিরোনামও ‘লাকী আখন্দ’। ১৯৯৯ সালে আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। কোন এক টার্মে ম্যাথ পরীক্ষা দিচ্ছি। হঠাৎ একটা অঙ্কে আঁটকে গেলাম। কিছুতেই মিলাতে পারছিনা। স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন কিছুই না বলে। স্যার চলে যাবার সাথে সাথেই গেয়ে উঠলাম ‘লিখতে পারিনা কোন অংক আজ সাহায্য ছাড়া, ভাবতে পারিনা কোন কিছু আজ সাহায্য ছাড়া। কি যে যন্ত্রণা, এই অংক করা’ (আমি তখন ছোট ছিলাম। চুটিয়ে গান শুনি আর পড়ালেখা করি। ‘প্যারোডি’ নামক শব্দটার সাথে আমি তখনও পরিচিত হয়ে উঠিনি। তাই আমার এই দৃষ্টতা ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখার আহ্বান করছি)। গানটিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। সেই সময়ের বর্ষ-সেরা গান এটি। জেমস্‌ তার সবটুকু উজার করে গেয়েছিলেন। সেই সময়ে ব্যান্ডসঙ্গীত ভক্ত শ্রোতাদের মুখে মুখে মাতাল হাওয়ার মত ভেসে বেড়াতো এই গান। জেমসের সেই গানটি সময়কে হারিয়ে দিয়ে আজও বাংলা সঙ্গীতাঙ্গনে চিরসবুজ গানের তালিকায় উদ্ভাসিত। ‘লিখতে পারিনা কোন গান আজ তুমি ছাড়া’-জেমসের এই বিখ্যাত গানটি শোনেন নি এমন শ্রোতাদের সংখ্যা হয়ত অনেক অনেক কম। কিন্তু গানটির গীতিকার কিংবা সুরকার কে ছিলেন সেই তথ্যটি অধিকাংশ শ্রোতারাই হয়ত জানেন না। অসম্ভব শ্রোতা নন্দিত এই গানটির গীতিকার ‘গোলাম মোর্শেদ’। গানটির সুরসংযোজনা ও সঙ্গীতপরিচালনায় ছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তী সুরকার, সঙ্গীতপরিচলাক ও গায়ক ‘লাকী আখন্দ’। লাকী আখন্দ, বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সুরকার, সঙ্গীতপরিচালক ও গায়ক। ১৯৮৪ সালে সারগাম এর ব্যানারে প্রকাশ পায় অসংখ্য শ্রোতানন্দিত ও ব্যপক জনপ্রিয় সব গানের সুরকার, সঙ্গীতপরিচলাক শিল্পী লাকী আখন্দের প্রথম সলো অ্যালবাম ‘লাকী আখন্দ’ (সেলফ্‌ টাইটেলড, লেভেলঃ সারগাম-১২০)। বাংলা সঙ্গীতের ক্ল্যাসিক সেই অ্যালবামের উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলোঃ

‘এই নীল মণিহার

‘আমায় ডেকোনা’

‘রীতিনীতি কি জানিনা’ ‘মামনিয়া’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘হৃদয় আমার’, ‘সুমনা’, ‘তোমার স্বাক্ষর আঁকা’। অবশ্য পরবর্তীতে ‘আমায় ডেকোনা’ গানটি তিনি শিল্পী সামিনা চৌধুরীকে উপহার দেন এবং সামিনা চৌধুরী তার একক অ্যালবামে গানটি সংকলন করেন গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী লেখা ও লাকী আখন্দের সুরারোপে করা এই বিখ্যাত গানটি। লাকী আখন্দের সুরারোপে করা প্রতিটি গানের কথার উপর সুরের যে প্রভাব তা যে কাউকেই সহজে মুগ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস। লাকী আখন্দকে তাই সুরের বরপুত্র হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না। সুর ও সঙ্গীতায়োজনের নান্দনিক ও বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনে তিনি কিংবদন্তী। সফট্‌-মেলোডি, মেলো-রক, হার্ড-রক যেটাতেই হাত দিয়েছেন সেটাই হয়ে উঠেছে এক একটি মাষ্টারপিস। তুমুল জনপ্রিয় গান ‘যেখানে সীমান্ত তোমার – কুমার বিশ্বজিৎ’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে – সামিনা চৌধুরী’, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা – হ্যাপী আখন্দ’, ‘কে বাঁশি বাজায়রে – হ্যাপী আখন্দ’, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে – হ্যাপী ও লাকী’, ‘নীল নীল শাড়ী পড়ে – লাকী আখন্দ’, ‘পাহাড়ি ঝর্ণা – লাকী ও হ্যাপী’, ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ – লাকী আখন্দ’ সহ আরও অনেক শিল্পীর অনেক অনেক জনপ্রিয় গান বাংলা সঙ্গীতের এই কিংবদন্তীর সুরারোপ ও সঙ্গীতায়োজনে করা। ১৯৮৭ সালে ছোট ভাই ‘হ্যাপী আখন্দের’ মৃত্যুর পরপর সঙ্গীতাঙ্গন থেকে অনেকটাই স্বেচ্ছায় নির্বাসন নেন এই গুণী শিল্পী। মাঝখানে প্রায় এক দশক নীরব থেকে ১৯৯৮-এ ‘পরিচয় কবে হবে’ ও বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ অ্যালবাম দুটি নিয়ে আবারও ফিরে আসেন সঙ্গীতাঙ্গনে। প্রাণের টানে ফিরে আসেন গানের মাঝে। সঙ্গীত ভক্ত শ্রোতাদের সৃষ্টির বেদনায় ভাসাতে আবারও দুটি হাত মেলে দিয়ে ধরেন সেই পুরোনো কীবোর্ডস, কথার পরতে পরতে সাজান সঙ্গীতের অপার্থিব স্বরলিপি। আর কথামালাগুলো সুরের ওম পেয়ে মেতে উঠে সৃষ্টির উল্লাসে। গীতিকার ‘গোলাম মোর্শেদ’এর কথামালায় প্রায় এক দশক পরে সঙ্গীতাঙ্গনের ছয় উজ্জ্বল তারকা শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ ও সামিনা চৌধুরীকে নিয়ে প্রকাশ করেন মিক্সড অ্যালবাম ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’। সেবারই তিনি প্রথমবারের মত পূর্ণাঙ্গ মিক্সড অ্যালবামের কাজ করেন। আর ফলাফল, সুপার ডুপার হিট একটি অ্যালবাম। জেমসের ‘লিখতে পারিনা’ ও ‘ভালোবেসে চলে যেওনা’ জায়ান্ট হিট হয়েছিল সেই সময়ে। এছাড়া এবি’র ‘কি করে বললে তুমি, তোমাকে হঠাৎ করে ভুলে যেতে’ কিংবা ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ কোন অংশে পিছিয়ে ছিলনা। যেমনটি ছিল না হাসান, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ কিংবা সামিনা চৌধুরীর গানগুলোও। আমি বিষ্ময়ে অভিভূত হয় যখনই মনেপড়ে গানগুলোর সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হলেন ‘লাকী আখন্দ’। (প্রতিটি গানের কথা আলাদাভাবে তুলে ধরতে গেলে পোষ্ট অনেক বড় হয়ে যাবে বিধায় সেগুলো উল্লেখ করছি না। এই অ্যালবামটি আমার শোনা অন্যতম সেরা অ্যালবাম। যত্ন সহকারে অন্তত একবার শুনে দেখার অনুরোধ করছি।)

১৯৮৭ সালে হ্যাপী আখন্দের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর হ্যাপী’র স্মৃতির উদ্দেশ্যে হ্যাপী আখন্দের একমাত্র সলো অ্যালবামটি আবারও রিমেক করেন। এরপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ১৯৮৮ সালে প্রকাশ করেন দ্বিতীয় সলো অ্যালবাম ‘পরিচয় কবে হবে’। একই সময়ে প্রকাশিত হয় ব্যান্ড ও আধুনিক মিক্সড ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’। ‘বিতৃষ্ণা জীবন আমার’ অ্যালবামের পর সাউন্ডটেকের ব্যানারে আবারও গোলাম মোর্শেদের লিরিকে সামিনা চোধুরীর সাথে করেন ডুয়েট অ্যালবাম ‘আনন্দ চোখ’।

এছাড়াও ১৯৯৯-এ প্রাইম অডিওর ব্যানারে প্রকাশিত ব্যান্ড মিক্সড ‘দেখা হবে বন্ধু’ অ্যালবামে আর্কের জনপ্রিয় শিল্পী হাসানের জন্য একটি গানের সুরারোপ করেন তিনি। হাসানের গাওয়া সেই গানটি হলো ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা কিছু ভালোবাসা দাও’। আজও আমি অভিভূত হই হাসানের কণ্ঠের উপযোগী করে কি চমৎকার ভাবেই-না তিনি গানটি সুরারোপ করেছিলেন। ক্ল্যাসিক হিট ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। কিংবা উপমায় ধারণ করা যেতে এমন কোন উপমাও আমার জানা নেই। আর তাই, উপমার দোহাই দিয়েই না-হয় আপনাদের জন্যই রেখে দিলাম এই অংশটুকু।

সঙ্গীতাঙ্গনে আমরা আমাদের গুণীজনদের যথাযথ মূল্যায়ন করিনি কিংবা করতে শিখিনি। আসুন সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি, আমরা আমাদের কিংবদন্তীদের হারিয়ে যেতে দেবো না কোনদিন। আমরা যেন আমাদের অবজ্ঞা ও অবহেলায় হীরের টুকরোগুলোকে কালের গর্ভে হারিয়ে না ফেলি। তাছাড়া, প্রতিটি গানের পেছনে থাকে শিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও যন্ত্রশিল্পীদের অনেক প্রত্যাশা ও যত্নের ছোঁয়া। আর তাই অন্তত প্রিয় গানগুলোর শিল্পী, গীতিকার ও সুরকারদের নাম জানার মাধ্যমে তাদের প্রতি আমাদের সন্মান প্রদর্শিত হয়। শ্রোতা হিসেবে এ আমাদের দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য।

  • Twitter Social Icon
  • Facebook Social Icon
  • Google+ Social Icon
  • LinkedIn Social Icon
Follow
"SAREGAMA JUST IN"

  জনপ্রিয় সংবাদ সা রে গা মা

বাংলা গান সা রে গা মা

Print  / Press Ctrl+P
Saregama Bangla

Sa Re Ga Ma News Archive

Write Yours Comments. 

RSS Feed

Reproduction of any content, news or article published on this website is strictly prohibited Privacy. 

bottom of page