top of page

জীবন সায়াহ্নে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোসলে।

পিতৃহীন পথচলা

মাত্র ৪২ বছর বয়সে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান লতা-আশার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর।

দীননাথ তেমন কিছু রেখে যাননি, যা দিয়ে সংসারের যাবতীয় খরচ চালানো যাবে। পাঁচ সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মা সুধামতী দিশেহারা। কে ধরবে সংসারের হাল?

গুরুদায়িত্বটা নিতে হলো ১২ বছরের মেয়ে লতাকে।

লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোসলে।

লতার স্কুল যাওয়া বন্ধ হলো লতা মঙ্গেশকর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে গেলে পানইনি। কেন? ছোট বোন আশার জন্য। চার বছরের ছোট বোনটি দিদি ছাড়া কিছু বুঝতেন না। দিদিও এক পা নড়তেন না বোনটিকে ছাড়া। স্কুলেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশি দিন এ অনিয়ম মানবে কেন? একদিন জানিয়ে দেওয়া হলো, ‘বোনকে নিয়ে স্কুলে আসা চলবে না।’ সঙ্গে সঙ্গেই বড় বোন ঠিক করে ফেললেন আর কোনো দিন যাবেন না স্কুলে। যানওনি। এর আগে বাবার মৃত্যুর সাত দিন পরই শোক লুকিয়ে লতা গেলেন ‌‘প্যাহলি মঙ্গলাগাঁও’ ছবির শুটিংয়ে। মারাঠি ছবিটিতে অভিনয় করে আর গান গেয়ে শুরু হলো কর্মজীবন। আশাও কিছু করতে চাইলেন পরিবার রক্ষার লড়াইয়ে নেমে লতার লতা মঙ্গেশকর হয়ে ওঠার সোপান তৈরির ওই সময়টাতে ছোট বোন আশাও কিছু একটা করতে চাইছিলেন। বয়স তখন ১০। এ সময় তাঁকে দেখা গেল মারাঠি ছবিতে।

‘মাঝা বাল’ ছবিতে তাঁর রেকর্ড করা প্রথম গান ‘চালা চালা নভ বালা’। পাঁচ বছর পর (১৯৪৮) হংসরাজ বেহলের ‘চুনারিয়া’ ছবির মাধ্যমে হিন্দি গানেও অভিষেক। গানের প্রথম কলি ‘সাওন আয়া’।

কালে কালে অনেক বেলা পেরিয়ে গেল। আশা তখন অদম্য কিশোরী। না বুঝে ভুল করার বয়স। প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে তাঁর চেয়ে ১৫ বছরের বড় গনপত রাও ভোসলেকে বিয়েই করে ফেললেন বাড়ি থেকে পালিয়ে। ওই পালিয়ে বিয়ে করা পর্যন্তই মিল, ‘প্রেম সাগর’, ‘পেয়ার হো তো অ্যায়সি’ বা ‘পিয়াসা সাওন’ মার্কা ছবির কাহিনির সঙ্গে। আদতে কিন্তু গনপত রাও বিয়ের পর আর নায়কের মতো আশার জীবনের সব মুশকিল আসান করে দেননি; বরং হয়েছেন আশাভঙ্গের কারণ। দুই বোনের দূরত্ব বড় বোন লতার সঙ্গে ছোট বোন আশার দূরত্ব তৈরি হয়। গনপতকে বিয়ে করায় আশার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন লতা। চার বছরের ছোট যে বোনের জন্য তাঁর লেখাপড়া হলো না, সংসারের দুর্যোগের সময় সেই বোন কিনা স্বার্থপরের মতো নিজের সুখের ঠিকানা খুঁজতে গেল? এ সময়ে বড় বোনের কাঁধে কাঁধ মেলানোটা তাঁর কর্তব্য—কথাটা আশা ভাবলেনই না! বিয়েটাকে লতা দেখলেন আশার স্বার্থপরতা হিসেবে। তার ওপর গনপতকে ছোট বোনের স্বামী হিসেবেও মানতে পারছিলেন না লতা। তাঁর ম্যানেজারের হাত ধরে আশা পালাতে পারেন, সেটা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেননি। পরিবারের জন্য কী কষ্টটাই না করতে হয়েছে লতাকে! কত দিন গ্র্যান্ট রোড থেকে ট্রেনে মালাড় গিয়ে সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে গিয়েছেন স্টুডিওতে, স্টুডিও থেকে আবার হেঁটে ফিরেছেন ট্রেন স্টেশনে। এভাবে ৫০ পয়সা ৫০ পয়সা করে একটি টাকা বাঁচিয়ে তা দিয়ে সবজি কিনে হাসিমুখে ফিরেছেন বাড়িতে। ছোট বোন হয়েও আশা তো মা, ভাই, বোনদের কথা এমন করে ভাবলেন না! এসব ভেবে অভিমানী লতা আর কথাই বলেন না আশার সঙ্গে। একসঙ্গে ডুয়েট গাইতে গিয়ে আশাকে যাতে দেখতে না হয়, সে জন্য ডান হাতে গানের খাতা নিয়ে মুখ সরিয়ে রাখেন। তিনি সেই বোন, একসময় মায়ের মতো তাঁকে বুকে আগলে রেখেছেন যিনি! কোলে করে নামার সময় সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার পরও যিনি কিনা বোনকে বুকে ধরে রেখেছিলেন, নিজের মাথা ফেটে রক্ত ঝরেছে, তবু আদরের বোন আশাকে ছাড়েননি!

বোনের এমন আচরণ খুব কষ্ট দিল। তখন তো আর ছোট্টটি নেই, আশা তত দিনে হেমন্ত আর বর্ষার মা। তাঁরও খুব অভিমান হলো। বোনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে নিজের গানের খাতাটা তুলে নিলেন বাঁ হাতে, দাঁড়ালেনও একটু পাশ ফিরে! অবশ্য নিয়তি লেখা ছিল অন্যভাবে। বেশি দিন বড় বোনের কাছ থেকে দূরে থাকতে দেয়নি নিয়তিই। বয়সে অনেক বড় এবং খুব বেশি রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে গনপত রাওয়ের সঙ্গে একেবারেই বনিবনা হচ্ছিল না। ভুল সব ভুল বিয়ের পর পারিবারিক অনুশাসনের জাঁতাকলে পড়ে আশা ভোসলে বুঝলেন, কম বয়সে পরিবার নির্বাচনেও বড় ভুল করে ফেলেছেন। দুর্ব্যবহার মাঝেমধ্যে চরমে উঠত। রেকর্ডিং সেরে ফিরতে ফিরতে রাত হলে কোনো কোনো দিন বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হতো না, সারা রাত বাইরে বসে থেকে ভোর হলে ঢুকতেন ঘরে! ছোট ছেলে আনন্দ পেটে থাকতে বেরই করে দেওয়া হলো তাঁকে, রাগে-দুঃখে স্বামীগৃহে আর ফেরেননি আশা। নিজের আয়ের টাকা, নিজের টাকায় কেনা গয়নাগাটি সব ফেলে হেমন্ত আর বর্ষাকে নিয়ে এক বস্ত্রে চলে যান মায়ের কাছে। সেদিন বড় বোন লতা মঙ্গেশকর আর মুখ ফিরিয়ে রাখেননি। পথচলা আশা ভোসলে.... আবার এক ঘরে থাকা শুরু হলেও লতার ছোট বোন হিসেবে পেশাগত জীবনে কোনো সুবিধা পাননি আশা। হিন্দি ছবির গানে তখন লতা, নূরজাহান, গীতা দত্তদের দাপট। সব ছবিতে তাঁরা গাওয়ার পর যেসব গান থাকত, সেগুলো দেওয়া হতো আশাকে। সোজা কথায় ‘বি’ বা ‘সি’ গ্রেডের গানগুলোই পেতেন আশা ভোসলে। অথচ কণ্ঠমাধুর্য কারও চেয়ে কম ছিল না। পণ্ডিত যশরাজ একবার বলেছিলেন বাণিজ্যিক ছবির গান ছেড়ে ক্ল্যাসিক্যাল গাওয়া শুরু করতে। একসময় সেভাবেই এগোতে লাগলেন তিনি। হলেন সফল। তৈরি হতে থাকল দুই বোনের আলাদা ইতিহাস।

লতা মঙ্গেশকর না আশা ভোসলে—রাহুল দেববর্মণও নিশ্চিত ছিলেন না, কে সেরা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মতে, আশাকে দিয়ে যেকোনো গান গাওয়ানো যায়। কিন্তু কিছু গান আবার লতা ছাড়া হয় না!’ একই প্রসঙ্গে গীতিকার, পরিচালক গুলজার বলেছিলেন, ‘চাঁদে দুটি লোক একই সঙ্গে নামল। তুমি যে প্রথম পা দিল, তাকে নিয়ে এমন নাচানাচি শুরু করলে যে অন্য লোকটার কথা ভুলেই গেলে। আরে, সে–ও তো ভাই চাঁদে একই সঙ্গে গিয়েছে।’ আশা ভোসলে তেমনি দ্বিতীয় জন। তাঁর গানের ভক্ত অনেক।

আজ ব্যক্তি আশা ভোসলেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করুন।

এক সাক্ষাৎকারে আশা ভোসলেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন গানে আপনাকে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করা যায়? হেসেই জবাব দিয়েছিলেন আশা, ‘জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা/ইঁহা কাল ক্যায়া হো কিসনে জানা...’ ঠিকই। আশা ভোসলের জীবনটা এ রকমই। অনেক চড়াই-উতরাই সেখানে। আশা বলে চলেন, ‘আর একটা গান আছে আমার সঙ্গে খুব যায়—“আগে ভি জানে না তু, পিছে ভি জানে না তু।” তুমি আগে কী হয়েছে জানো না, পরে কী হবে, তা–ও জানো না। তা হলে এত ভেবে কী করবে?’ এই হচ্ছে আশা ভোসলে। অনেকে বলে থাকেন, বড় বোন লতার যুগে জন্ম নেওয়াটা যাঁর জীবনে সবচেয়ে দুর্ঘটনা। কিন্তু যাঁর নামেই আশা, তিনি কেন দুর্ঘটনাকে পাত্তা দেবেন? গান ও সংসার সমান্তরালে আশা ভোসলে কিংবদন্তি গায়িকা। পাশাপাশি পুরোদস্তুর সংসারী এক নারী, সফল মা। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, এতটা ‘কমপ্লিট উইমেন’ হওয়া কী করে সম্ভব? আশা ভোসলে বলেছিলেন, ‘আমি চাই মানুষ আমাকে মনে রাখুক সেই নারী হিসেবে, যে সৎ মন নিয়ে আপ্রাণ কাজ করেছে। যে কাজ থেকে কখনো পালিয়ে যায়নি। যে কাজ পেলেই এনার্জি পেয়ে গেছে। যে মঞ্চে পারফর্ম করেই বসে থাকেনি। যে স্টেজ থেকে নেমে আবার সংসারটা চালিয়েছে। যে নিজে রান্না করেছে। যে পরিবারের সবাইকে দেখেছে। যে কর্তব্য সামনে দেখলেই নতুন এনার্জিতে ভরপুর হতে পেরেছে।’ প্রশ্ন ছিল, এই বয়সেও যে এত উদ্যম, শরীরজনিত সমস্যা নেই? আশার জবাবটা ছিল পরিষ্কার, ‘আমার রক্তচাপ পুরোপুরি ঠিক আছে। সুগার নেই। কোলেস্টেরল নেই। তবে হিমোগ্লোবিনটা একটু কম আছে। মাঝেমধ্যে সেটা বেশ সমস্যা করে। পাত্তা দিই না। সেটা নিয়েই লড়ছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ষাট হতে না হতেই বেশির ভাগ মানুষ খুব মনমরা হয়ে পড়ে। অবসরজীবনে তারা হতাশায় ভোগে। অনেককে দেখেছি অবসরে যাওয়ার আগেই প্ল্যানিং করছে, আহা দুপুরে আরামে ঘুমোতে পারব! কিন্তু আমার কাছে সেটা আলসেমি। আমি অসুস্থ না হলে জীবনে দুপুরে ঘুমাইনি। একদম হাতে কাজ না থাকলে ঘর পরিষ্কার করি। চুপ করে বসা আমার ভাগ্যে নেই। আমার সাফ কথা হলো, ভাই, জীবনে থাকতে হলে সামনে তাকাতে হবে। দৌড়াতে হবে। কিসের অবসর? “অবসর” শব্দটাই আমার কাছে অরুচির। আমি বলব, অবসরের আগে মনে মনে ছকে নিন, এবার নতুন নতুন কী কাজ করবেন।’ আশার নেশা রান্না আর পড়া আশার ছোটবেলার কথা। ভারতে তখনো ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। ছোট্ট আশা মঙ্গেশকর তাই কোনো কোনো দিন খোলা দরজা দিয়ে আসা রাস্তার লাইটের আলোয় বই পড়তে পড়তে কাটিয়ে দিতেন সারা রাত। পড়ার এমনই নেশা ছিল তখন। নেশাটা কিন্তু যায়নি। মারাঠি সাহিত্য, মারাঠিতে অনুবাদ করা যেকোনো ভাষার উপন্যাস বা হিন্দি গল্প—হাতের কাছে পেলে কিছুই এখনো ছাড়েন না। নিয়মিত লেখালেখিও করেন ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকায়। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘গায়িকা না হলে কী হতেন?’ আশার ঝটপট জবাব, ‘পেশাদার রাঁধুনি হতাম। বেছে বেছে চারটা বাসায় রান্না করে প্রচুর টাকা কামাতাম। হা হা হা।’ রান্না করতে খুব ভালোবাসেন তিনি। রাঁধেনও চমৎকার। মুম্বাইয়ের অনেক নায়ক-নায়িকাই তাঁদের প্রিয় আশাজীকে পেলে মাংস আর বিরিয়ানি খাওয়ানোর জন্য চেপে ধরেন। কাপুর পরিবারে তো আশা ভোসলের রান্না করা মাছ, পায়া কারি আর ডাল ভীষণ জনপ্রিয়। ‘আশাজ’ নামে দশটা রেস্তোরাঁ আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।

পাঁচ ভাই বোন (আশা,মিনা,লতা,ঊষা,হৃদয় )

নিজেকে ঠিক রাখার মন্ত্র মঙ্গেশকর পরিবারের তৃতীয় সন্তান আশার জীবনে কঠিন সময় এসেছে বহুবার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন গণপত রাও ভোসলেকে। প্রথম বিয়েতে সুখী হননি। বিচ্ছেদের পর ১৯৮০ সালে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সুরকার, সংগীত পরিচালক রাহুল দেববর্মণকে। ১৪ বছর সংসার করার পর রাহুল মারা যান। রাহুল দেববর্মণের মৃত্যুর পর আদৌ তাঁদের বিয়ে হয়েছিল কি না, এসব নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন আশা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ছেলে মৃত্যু দেখেছেন। দেখেছেন সব সময়ের সঙ্গী একমাত্র মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুও। লড়াই করতে অনেকেই পারে, কিন্তু এত সব উথালপাতালের মধ্যে নিজেকে ঠিক রাখার মন্ত্র কী? আশা ভোসলে আশাবাদী জবাব দিলেন, ‘নিজেকে বোঝানো। সবার জীবনে খারাপ দিন আসে, ভালো দিন আসে। নিজের মধ্যে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে, খারাপ দিনে যতই ঝোড়ো হাওয়া দিক, নিজের জায়গা থেকে নড়ব না। নিজের মেহনত থেকে সরব না। একদিন না একদিন সময় ফিরবেই।’

বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমে তাঁর দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে লিখেছেন মাসুম আলী। (Prothom Alo)

  • Twitter Social Icon
  • Facebook Social Icon
  • Google+ Social Icon
  • LinkedIn Social Icon
Follow
"SAREGAMA JUST IN"

  জনপ্রিয় সংবাদ সা রে গা মা

বাংলা গান সা রে গা মা

Print  / Press Ctrl+P
Saregama Bangla

Sa Re Ga Ma News Archive

Write Yours Comments. 

RSS Feed

Reproduction of any content, news or article published on this website is strictly prohibited Privacy. 

bottom of page