বিদেশি চ্যানেলে দেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারী করল, নতুন সংগঠন ‘মিডিয়া ইউনিটি’
নভেম্বর মাসের পর বিদেশি কোনো চ্যানেলে দেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করলে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর স্বার্থরক্ষায় গঠিত নতুন সংগঠন ‘মিডিয়া ইউনিটি’। সেইসঙ্গে দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় বিদেশি ডাবিং করা সিরিয়াল প্রচার বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। ‘মিডিয়া ইউনিটি’ দেশীয় চ্যানেলগুলোর মালিক, কর্মকর্তা, নির্মাতা, কলাকুশলী, লেখক, অভিনেতা, বিজ্ঞাপনদাতাদের সমন্বয়ে গঠিত।
যারা দেশের বিজ্ঞাপন ভারতীয় চ্যানেলে নিয়ে যাওয়ার পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তাদের ‘সাংস্কৃতিক রাজাকার’বলে অভিহিত করেন দেশের প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল এটিএন বাংলার প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজুর রহমান।
মাহফুজুর রহমান আরোও বলেন, আমাদের দেশের বিজ্ঞাপন যারা বিদেশের চ্যানেলে নিয়ে যাচ্ছে তাদের নভেম্বর পর্যন্ত সময় দিলাম। এরপর তারা এই কাজ করার চেষ্টা করলে সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, আমি পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে আধা ঘণ্টার অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে রাজি আছি। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞাপনদাতারা কি এত রেটে বিজ্ঞাপন দিতে প্রস্তুত? ভারতীয় চ্যানেলে দেড় লাখ টাকার নিচে বিজ্ঞাপন দেয়া যায় না আর আমাদের চ্যানেলে বিজ্ঞাপনের রেট ৩০ হাজার টাকা থেকে নেমে পাঁচ হাজারে দাঁড়িয়েছে। ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণ হবে কীভাবে? মিডিয়ার একাধিক প্লাটফর্ম থেকে আন্দোলন না করে এখন থেকে মিডিয়ার সবাই মিডিয়া ইউনিটের ব্যানারে দাবি আদায়ের আন্দোলন করবে।
একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবুকে আহ্বায়ক ও দেশ টেলিভিশনের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফুর রহমানকে সদস্য সচিব করে একটি অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। অনুষ্ঠানে একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু বলেন, পৃথিবীর সব পে-চ্যানেল ল্যান্ডিং ফি দিয়ে বিজ্ঞাপন শূন্যভাবে প্রচার করে। অথচ আমাদের দেশে আইনের ফাঁক দিয়ে কিছু সুবিধাবাদী ব্যক্তি বিজ্ঞাপনের নামে বাংলাদেশের টাকা অবৈধভাবে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করছে। দেশ টিভির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হাসান বলেন, বিজ্ঞাপনদাতাদের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। সুযোগ পেলে সবাই সৎ ব্যবহার করতেই চাইবে। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থে আমরা এমন কোনো কাজ করতে পারি না যা আমাদের সংস্কৃতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ক্ষতিকারক হবে। সময় টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ যুবায়ের বলেন, ২০১৪ সালে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ডাউনলোড চ্যানেলগুলোর জন্য একটি ফি নির্ধারণের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় নিয়মটি আর কার্যকর হয়নি। এমনি আগে দেশীয় কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিদেশি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের দর ছিল দেড়গুণ। এখন সেটিও সমান করে ফেলা হয়েছে। ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, একুশে টিভি প্রথমবার বন্ধ হলে প্রায় ৬০০ স্টাফ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৫০ হাজার কর্মজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্টদের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, হয়তো আজকের অনুষ্ঠানে যারা নিউজ কাভারেজ করছেন তাদের আবার বিয়ে বাড়ির ভিডিও করতে হবে। গান বাংলা টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৌশিক হাসান তাপস বলেন, নিজেদের মধ্যে সমন্বয় থাকলে দাবি আদায় কোনো ব্যাপার নয়। আর প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝাতে পারলে অবশ্যই তিনি সেটা বুঝবেন এবং দ্রুত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে ১৫ মিনিট দেশের সব চ্যানেলের ট্রান্সমিশন বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের (ইমা) সভাপতি রঞ্জন দত্ত বলেন, ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরাই সর্বপ্রথম ইস্যুটি সবার সামনে নিয়ে আসি। সংকুচিত বাজারের কথা চিন্তু করে বিষয়টির সঙ্গে আমরা তখন টেলিভিশন মালিকদের সম্পৃক্ত হবার আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তারা সাড়া দেননি। গত এক বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে চলে গেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে আদালতের মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ না নিতে পারলে বাজার অর্ধেক হয়ে যাবে। প্রডিউসারদের পক্ষে মনোয়ার হোসেন পাঠান বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন চ্যানেল ডাবিং করা বিদেশি সিরিয়ালের সম্প্রচার বাড়ছে। ফলে দেশীয় শিল্পী এবং কলাকুশলীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ডিরেক্টর গিল্ডের সভাপতি গাজী রাকায়েত বলেন, আমি এবং এস এ অলিক উত্তরার প্রডাকশন হাউজগুলোতে খবর নিয়ে দেখেছি ৭০ ভাগ শুটিং হাউজেই কোনো কাজ নেই। আমরা ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে ৮টি সংগঠন নিয়ে একটি ফেডারেল বডির মাধ্যমে দেশীয় চ্যানেলগুলোতে ডাবিংকৃত বিদেশি সিরিয়াল বন্ধের জন্য কাজ করবো। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন এশিয়ান টেলিভিশন এবং এশিয়ান রেডিওর চেয়ারম্যান আলহাজ হারুন-উর-রশিদ, বিজয় টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওফেল আহমেদ, অভিনেতা শহিদুজ্জামান সেলিম, শোয়েব, অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী ও নাট্যকার মাসুম রেজা।
চলতি মাসের মধ্যেই বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন এবং দেশি চ্যানেলে ডাবিং করা বিদেশি সিরিয়াল বন্ধের দাবি জানান সংগঠনটির নেতারা। অনুষ্ঠান থেকে জানানো হয়, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে ডাবিং করা বিদেশি সিরিয়ালের সম্প্রচার বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন। এর ফলে একদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতির মুখে পড়ছেন দেশীয় চ্যানেল, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। শুধু বিজ্ঞাপন ও বিদেশি সিরিয়াল সম্প্রচার বন্ধ নয়, সব ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ারও আহ্বান জানান মিডিয়া ইউনিটির সদস্যরা। এসব দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন বেসরকারি টেলিভিশনের পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা।
এই জাতীয় আরোও পোষ্ট দেখুন ঃ