top of page

লাখো বাঙালির হৃদয়ের নায়িকা, বাংলাদেশের কন্যা- “সুচিত্রা সেন”

বাংলা চলচ্চিত্রের চির স্মরনীয় মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মরণে সারেগামা পরিবারের ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা, পাবনার মেয়ে সুচিত্রা সেনের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৪ সালের এই দিনে ভারতের কলকাতায় বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

পাবনার রমা থেকে কলকাতার সুচিত্রা


১৯৩১ সালের কথা। বাংলাদেশের পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে করুনাময় দাশগুপ্ত আর ইন্দিরা দাশগুপ্তের পরিবারে চোখ মেলল রমা, রমা দাশগুপ্ত।

পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় কন্যা সন্তান হলেও রমার জন্মে আপ্লুত স্কুল শিক্ষক করুনাময় পুরো এলাকার মানুষকে মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন সেদিন। তৎকালীন বৃহত্তর পাবনার বেলকুচি উপজেলার সেন ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে নানা রজনীকান্ত সেনের বাড়িতে ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন রমা সেন। সুচিত্রা সেনের দাদার আগের পুরুষদের বাড়ি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলায়। পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনের একতলা পাকা পৈত্রিক বাড়িতে আজকের সুচিত্রা সেনের শিশুকাল, শৈশব ও কৈশরকাল কেটেছে। বাড়িটির প্রতিটি কক্ষের কোনায় কোনায় জড়িয়ে আছে তার স্মৃতি। কিন্তু বর্তমানে সুনশান নিরবতায় ঝোপ জঙ্গল আর ভঙ্গুর অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই, আগে কতটা জীবন্ত ছিল বাড়িটি।


সুচিত্রা সেনের বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনা পৌরসভার তৎকালীন সেনেটারি ইন্সপেক্টর পদে চাকরি করতেন। মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত ছিলেন গৃহিনী। পাবনা শহরের মহাকালী পাঠশালায় পড়ালেখা শেষে সুচিত্রা সেন স্থানীয় পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কিছু দিন আগে পারিবারিক প্রয়োজনে সুচিত্রা সেন কলকাতা চলে যান। ১৯৫১ সালের মাঝামঝি সময়ে সুচিত্রা সেনের বাবা করুণাময় দাসগুপ্ত সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। সে সময় জেলা প্রশাসন ঊর্র্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক ভিটা গোপালপুর মৌজার এসএ ৯৯ খতিয়ানভুক্ত ৫৮৭ এসএ দাগের ০.২১২৫ একর বাড়িটি রিক্যুইজিশন করেন। এরপর থেকে বাড়িটিতে সরকারি বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বসবাস করতে থাকেন এবং সর্বশেষ ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট।


১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকারের সময়ে তৎকালনী জেলা প্রশাসক মো. সাইদুর রহমানের সহযোগিতায় জামায়াত নেতা মাওলানা আব্দুস সোবাহানসহ অন্যান্যরা সুকৌশলে বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তিতে পরিণত করে একসনা লিজ নিয়ে ‘ইমাম গায্যালী ইন্সটিটিউট’ নামের একটি কিন্ডার গার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ সময় বাড়িটির অনেক মূল্যবান ফলজ ও বনজ বৃক্ষ কেটে দখলকারীরা বাড়ির সবুজ বেষ্টনী উজাড় করে দেয়।


এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকেই সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক নিবাসটি জামায়াতের কবল থেকে মুক্ত করে সুচিত্রা সেন আর্কাইভ বা সংগ্রহশালা করার জন্যে স্থানীয় সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল ব্যক্তিরা দাবি তুললেও রাজনৈতিক কারণে বাড়িটি দখলমুক্ত হয়নি দীর্ঘদিন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক ভিটা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের কবল থেকে উদ্ধার করে সেখানে সুচিত্রা আর্কাইভ বা সংগ্রহশালা করার জন্য স্থানীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতারা ২০০৯ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করেন। গঠন করা হয় সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ।


এর মধ্যে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি মহানায়িকা রমা সেন ওরফে সুচিত্রা সেন। মৃত্যুর আগে তার বাড়িটি উদ্ধার দেখে যেতে না পারলেও মৃত্যুর ছয় মাসের মাথায় একই বছরের ১৭ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশে সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়ি অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করে জেলা প্রশাসন। পাবনাবাসীর দাবি ছিল বাড়িটিতে সুচিত্রা সেন স্মৃতি আর্কাইভ করার। কিন্তু নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক ভিটা দখলমুক্ত করার দেড় বছর পার হলেও দখলমুক্ত বাড়িটিতে ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি আর্কাইভ’ করার যে পরিকল্পনা তার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এ নিয়ে হতাশ জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীরা।


পাবনার সঙ্গীত শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী শেখ তোজা ফাহমিদা চাঁদনী বলেন, সুচিত্রা সেনের মতো এত বড় একজন নায়িকা পাবনার মেয়ে-এটা আমাদের জন্য গর্বের একটি বিষয়। তার সব অভিনয় বা কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হই। আমরা জানি পাবনায় তার পৈত্রিক বাড়িটি অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সুচিত্রা সেনের জন্ম বা মৃত্যুদিনে তার বাড়িটিতে আমরা গিয়ে স্মৃতিচারণ করতে পারি না। আমরা চাই বাড়িটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক।


গণমাধ্যমকর্মী সরোয়ার উল্লাস বলেন, বাড়িটি উদ্ধারের জন্য এত আন্দোলন, মানববন্ধন, চলচ্চিত্র উৎসব করা হলো। সেই বাড়িটি উদ্ধারও হলো, কিন্তু গত দেড় বছরেও সেখানে কিছু করা হলো না। এতে শুধু পাবনাবাসী নয়, সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ হতাশ। বাড়িটি অবহেলায় পড়ে আছে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোনো কিছু করা হয়নি। আমরা চাই খুব দ্রুত এই বাড়িটিতে কিছু করা হোক সুচিত্রা সেনের নামে।


একুশে বইমেলা উদযাপন পরিষদ, পাবনার সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, উদ্ধারকৃত বাড়িতে সুচিত্রা সেন স্মৃতি আর্কাইভ করার যে আবেদন আমাদের ছিল সেই পরিকল্পনা সরকারেরও আছে। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি আমরা লক্ষ্য করেছি। সরকার কখনোই এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করতে চায় না। তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আমরা পাবনার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সহ সবাইকে সাথে নিয়ে আবার নতুন উদ্দোমে চেষ্টা করে বাড়িটিতে সুচিত্রা সেনের নামে আর্কাইভ করার।


সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ পাবনার সাধারণ সম্পাদক ডা. রামদুলাল ভৌমিক বলেন, সুচিত্রা সেনের স্মৃতি ধরে রাখতে তার নামে বাড়িটিতে কিছু একটা করার আমাদের যে দাবি তার সঙ্গে সরকারও একমত। আমরা সে বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাও দিয়েছি। কিন্তু তার কোনো অগ্রগতি নেই। তিনি জানান, আমরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে সাড়ে তিন কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা জমা দিয়েছি। সেটি বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আছে। কিন্তু সেখান থেকে সরকারের কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি। আর সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত না হলে আর্কাইভ করার কাজটি এগোবে না। আমরা আশাবাদী সরকার দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে সুচিত্রা সেন স্মৃতি আর্কাইভ করার কাজটি শুরু করবে।


সুচিত্রা সেনের জন্ম বাংলাদেশে এবং তিনি বাঙ্গালী এ জন্য আমরা গর্ববোধ করি।

পাবনার জেলা প্রশাসক কাজী আশরাফ উদ্দীন জানান, আদালতের নির্দেশে সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়িটি দখলমুক্ত হয়ে বর্তমানে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। তবে বাড়িটিতে তী করা হবে সে বিষয়ে সরকার থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আমরা পাইনি। আর খুব শিগগিরই পাবনায় সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হবে বলেও জানান তিনি।


পুরস্কার ও সম্মাননা

সুচিত্রা সেন ১৯৬৩ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে সাত পাকে বাঁধা ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী পান। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলাবিভূষণ সম্মাননা দেওয়া হয় তাঁকে। ২০০৫ সালে সুচিত্রা সেনকে ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে সুচিত্রা সেন দিল্লিতে গিয়ে ওই সম্মান গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।


সুচিত্রা সেনের ছবি

সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবি শেষ কোথায়। ১৯৫২ সালে ছবিটি নির্মিত হলেও তা আর মুক্তি পায়নি। ১৯৫৩ সালে অভিনয় করেন সাত নম্বর কয়েদি ছবিতে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৮ এই ২৬ বছরে তিনি ৬২টি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে তিনি প্রথম ছবি করেন সাড়ে চুয়াত্তর। এ ছবিটি বক্স অফিস হিট করে। সুচিত্রা সেনের অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে : অগ্নি পরীক্ষা (১৯৫৪), গৃহ প্রবেশ (১৯৫৪), ঢুলি (১৯৫৪), মরণের পরে (১৯৫৪), দেবদাস (১৯৫৫-হিন্দি), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), মেঝ বউ (১৯৫৫), ভালবাসা (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), ত্রিযামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৭), পথে হল দেরী (১৯৫৭),জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), মুশাফির (১৯৫৭-হিন্দি), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রানী (১৯৫৮), দ্বীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), হসপিটাল (১৯৬০), বোম্বাই কা বাবু (১৯৬০-হিন্দি), সপ্তপদী (১৯৬১), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), মমতা (১৯৬৬), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), মেঘ কালো (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২), দেবী চৌধুরাণী (১৯৭৪), শ্রাবণ সন্ধ্যা (১৯৭৪), প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫), আঁধি (১৯৭৫-হিন্দি), দত্তা (১৯৭৬) এবং সর্বশেষ প্রণয়পাশা (১৯৭৮)।


সূত্র: সুচিত্রা সেনের জীবনী সংক্রান্ত তথ্যাবলী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ইন্টারনেট থেকে নেয়া হয়েছে। সকল লেখকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

  • Twitter Social Icon
  • Facebook Social Icon
  • Google+ Social Icon
  • LinkedIn Social Icon
Follow
"SAREGAMA JUST IN"

  জনপ্রিয় সংবাদ সা রে গা মা

বাংলা গান সা রে গা মা

Print  / Press Ctrl+P
Saregama Bangla

Sa Re Ga Ma News Archive

Write Yours Comments. 

RSS Feed

Reproduction of any content, news or article published on this website is strictly prohibited Privacy. 

bottom of page