শুভ জন্মদিন অঞ্জন দত্ত!
গত ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠিত অঞ্জন দত্ত ও অনুপম রায়ের কনসার্টে অঞ্জন দত্তের পারফর্মেন্স ৷
ছবি কৃতজ্ঞতায় | অভীক সরকার ৷
প্রখ্যাত বাঙ্গালী নির্মাতা মৃণাল সেনের হাত ধরে চলচ্চিত্রে যার হাতেখড়ি। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নয়, একাধারে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক এবং এবং প্রযোজকও। শিল্পী হিসেবেও তিনি ততোধিক পরিচিত। অভিনয়ের পরে গানের জগতে পা রেখে সেখানেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে নেন এই মানুষটি। তার চলচ্চিত্র দিয়ে যেমন কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্রে ঘটেছে গুণগত একটা পরিবর্তন, ঠিক তেমনি বাংলা গানের জগতেও। অজস্র সিনেমা, টেলিফিকশনে অভিনয় করেছেন। তার পরিচালিত ছবির সংখ্যা ১৫ ছাড়িয়ে গেছে। নিজের লেখা ও সুর করা জনপ্রিয় গানের সংখ্যা অন্তত তিনশো। ‘এটা কি ২৪৪১১৩৯’-ছুঁয়েছে জনপ্রিয়তার শঙ্খচূড়া। ১৯৯৪ সালে ‘শুনতে কী পাও’ অ্যালবামের পর একেএকে পুরনো গিটার, কেউ গান গায়, চলো বদলাই, হ্যালো বাংলাদেশ, কলকাতা-১৬, অসময়, রং পেন্সিল অ্যালবামগুলো বাংলা গানের জগতে সাড়া ফেলে দেয়। গান গেয়ে ঘুরে বেড়ান সারা পৃথিবী। সত্যজিৎ রায় এর চলচ্চিত্রে অভিনয় করার বিরল সৌভাগ্যও হয় তার। মৃণাল সেন ছাড়াও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেনের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। হিন্দী ছবি ‘বড়দিন’-এর মধ্য দিয়ে পরিচালনায় হাত দেন। ইংরেজী ভাষার ছবি ‘বো ব্যারাক ফরএভার’, বং কানেকশন, চলো-লেটস গো, ম্যাডলি বাঙ্গালী, ব্যোমকেশ বক্সী, রঞ্জনা আমি আর আসবোনা, আবার ব্যোমকেশ, দত্ত ভার্সেস দত্ত, গণেশ টকিস ও শেষ বলে কিছু নেই-এর মত তুমুল জনপ্রিয় ছবিগুলোরও নির্মাতা তিনিই।
নাম তার অঞ্জন দত্ত। আজ বাংলা গান ও চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় এ শিল্পীর ৬৪তম জন্মদিন। কিছুতো সেলিব্রেশান চাই! অঞ্জন প্রায়ই আসেন বাংলাদেশে। এই এসেছিলেন ক’দিন আগেও। তেমনই এক সফরে তার মুখোমুখি হন শিমুল সালাহ্উদ্দিন ও সানজিদা ইসলাম পদ্মা। জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত হল তাদের সেই কথপোকথন।
তুষার আব্দুল্লাহর গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র ‘মনবাক্স’ পরিচালনা করতে বাংলাদেশে আসেন অঞ্জন দত্ত। সে সময় তার সাথে তার গান সিনেমা আর নির্মাতা সত্ত্বা নিয়ে বিস্তারিত আড্ডা দেন শিমুল সালাহ্উদ্দিন ও সানজিদা ইসলাম পদ্মা। ১৯ জানুয়ারি জন্ম নেয়া দুই বাংলার তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী অঞ্জন দত্তেরর জন্মদিন উপলক্ষে সেই দীর্ঘ আড্ডা প্রকাশ হলো আজ..
_______________________
অঞ্জন দত্ত। প্রখ্যাত বাঙ্গালী নির্মাতা মৃণাল সেনের হাত ধরে চলচ্চিত্রে যার হাতেখড়ি। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নয়, একাধারে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক এবং এবং প্রযোজকও। শিল্পী হিসেবেও তিনি ততোধিক পরিচিত। অভিনয়ের পরে গানের জগতে পা রেখে সেখানেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে নেন এই মানুষটি। তার চলচ্চিত্র দিয়ে যেমন কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্রে ঘটেছে গুণগত একটা পরিবর্তন, ঠিক তেমনি বাংলা গানের জগতেও। অজস্র সিনেমা, টেলিফিকশনে অভিনয় করেছেন। তার পরিচালিত ছবির সংখ্যা ১৫ ছাড়িয়ে গেছে। নিজের লেখা ও সুর করা জনপ্রিয় গানের সংখ্যা অন্তত তিনশো। ‘এটা কি ২৪৪১১৩৯’-ছুঁয়েছে জনপ্রিয়তার শঙ্খচূড়া। ১৯৯৪ সালে ‘শুনতে কী পাও’ অ্যালবামের পর একেএকে পুরনো গিটার, কেউ গান গায়, চলো বদলাই, হ্যালো বাংলাদেশ, কলকাতা-১৬, অসময়, রং পেন্সিল অ্যালবামগুলো বাংলা গানের জগতে সাড়া ফেলে দেয়। গান গেয়ে ঘুরে বেড়ান সারা পৃথিবী। সত্যজিৎ রায় এর চলচ্চিত্রে অভিনয় করার বিরল সৌভাগ্যও হয় অঞ্জন দত্তর। মৃণাল সেন ছাড়াও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেনের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। হিন্দী ছবি ‘বড়দিন’-এর মধ্য দিয়ে পরিচালনায় হাত দেন। ইংরেজী ভাষার ছবি ‘বো ব্যারাক ফরএভার’, বং কানেকশন, চলো-লেটস গো, ম্যাডলি বাঙ্গালী, ব্যোমকেশ বক্সী, রঞ্জনা আমি আর আসবোনা, আবার ব্যোমকেশ, দত্ত ভার্সেস দত্ত, গণেশ টকিস ও শেষ বলে কিছু নেই-এর মত তুমুল জনপ্রিয় ছবিগুলোরও নির্মাতা তিনিই।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: অঞ্জনদা, একটা স্মৃতির কথা বলে শুরু করি, আপনি একটা ইন্টারভিউতে দাবি করছিলেন যে আপনি নিজের কাছে ভয়ঙ্কর রকমের সৎ। আপনি যখন কোন কাজে ডুবে যান তখন ঐ কাজ সংশ্লিষ্ট ছাড়া কাউকেই প্রায় চেনেন না। প্রথমেই জানতে চাই, আপনি প্রায় দশ বছরের বিরতির পর নতুন গানের অ্যালবাম করলেন, ঊনষাট। এত দীর্ঘবিরতি কেন? আপনার এই দীর্ঘ গ্যাপটা কি আপনার সিনেমা বা এমন অর্থকরি প্রজেক্টের পেছনে ছোটা, সেটাই প্রমাণ করে না যে আপনি টাকার পেছনে ছুটছেন?
অঞ্জন দত্ত: তোমার স্মৃতিচারণ আমাকে আবেগকাতরই করে দিলো। দ্যাখো, গান আমাকে অনেক বেশি টাকা দিয়েছে।চলচ্চিত্রের থেকেও অনেক বেশি টাকা। আমি আমার বাবার দেনা শোধ করেছি গান গেয়ে। টাকা পেয়ে। গান আমায় যে টাকা দিয়েছে চলচ্চিত্র আমাকে সে টাকা কোন দিনই দেয়নি। আমি এখনো বছরে প্রায় দশ বারোটা শো বিদেশে করি, লন্ডন, অ্যামেরিকা, বিভিন্ন জায়গায়। দিল্লি বম্বেতো আছেই, ব্যাঙ্গালোর। কিন্তু সিনেমা দিয়ে আমার যাত্রা শুরু। আমি যে ছবিগুলোতে অভিনয় করেছি সেগুলোতে আর্ট লাগানো ছিলো। কত টাকা পেয়েছি বলো!
শি.সা.: মৃণাল সেন? অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ, টাকার জন্য আমি সেসব সিনেমা করিনি। আমি নিজে যে সিনেমাগুলি করেছি বাংলা সিনেমা, সেগুলি অন্যজায়গায়, অনেক অন্যদিকে নিয়ে গেছে। বংকানেকশন, ম্যাডলি বাঙালি, চলো লেটস গো..
শি.সা: সেটাতো গত দশ বছরের কথা! অঞ্জন দত্ত: না, টু থাউজ্যান্ড ফোর থেকে, হ্যাঁ এখন দশ বছর চলছে, তবে সেগুলো কিন্তু বিগ বাজেট ছবি, তা নয়। তুষারের ছবিটা করতে এসেছি, এটাও কিন্তু পাগলু বা দেব বাজিৎ এর ছবির মতো আট কোটি টাকা ছ কোটি টাকার বাজেটের ছবি নয়। ওর গল্পটা খুব ভালো। ভালো ছবি হবে। হ্যাঁ, খরচা বেশি হয়, ভালোই হয়। কিন্তু ভালো ছবি বা রুচি সম্পন্ন ছবি। কপি ছবি নয়। আমি গান লিখছি না, দশ বছর গান করছি না কারণ ভালো গান আসছে না আমার। আমার মনে হয় যদি ভালো গান লিখে থাকি কিছু আমি, আমি বৃষ্টি দেখেছি’র মতোন গান যদি আসে আবার আমি লিখবো, কাঞ্চনের মতোন—
শি.সা: আলিবাবা! অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ, পরের দিকে আমার মনে হয় খুব ভালো গান হয়নি। আকাশ ভরা সূর্যতারা, কাঞ্চন জংঘা, আলিবাবা এই কিছু গান নিয়ে আমি খুব গর্বিত। রঞ্জনা আমি আর আসবো না, কিছু গান নিয়ে আমি খুব গর্বিত। আবার কিছু গান আমার সে রকম জমে না। হয়তো জনপ্রিয় হয়েছে। সেই কারণে আমি দেখেছি যে অ্যালবাম না করে, পুরনো গানই গাই, অত কিন্তু আমি এ্যালবাম আমি করছি না কিন্তু তবু আমার প্রোগ্রাম লেগে আছে। আমি ফিরে যাবো পরশুদিন, তারপর প্রতিদিন কিন্তু আমার শো আছে, আবার দিল্লীতে শো আছে, বম্বেতে শো আছে, ব্যাঙ্গালোরে শো আছে, পর পর পর পর পুজো অব্দি আমার শো আছে। এবং অক্টোবর মাসটা পুরো আমি এখানে আসতে পারবো না কারণ আমার শোজ রয়েছে।সেই গানগুলো তো আমার পুরনো গান। মঞ্চে মঞ্চে আমি রঞ্জনা, বেলা বোস, মেরিয়ান, এগুলোই গাইছি। সেগুলো লোক শুনছে। সেরকম ভালো গান যদি না লিখতে পারি তাহলে আমি লিখবো না। বয়স বেড়ে গেছে। দশ বছর পর আমার মনে হলো, ঊনষাট এ এসেআমি কিছু অন্য রকম কথা বলতে পারছি, অন্যরকম গান আমি লিখবো ,রেগুলার বেসিসে যদি ভালো গান না হয়, আমি যদি ভালো ছবি না করতে পারি, আমি ছবি করবো না, জোর করে প্রতি বছরে বছরে একটা ছবি করার কোন মানে হয় না।
শি.সা: কিন্তু দাদা চলচ্চিত্রে যদি আপনার যাত্রাটা আমরা একটু খেয়াল করি, আপনি বম্বেতে মানে বলিউডে আপনি একটা চলচ্চিত্র দিয়ে শুরু করলেন... পদ্মা: বড়দিন। শি.সা: এই শুরুটা আপনি কলকাতায় না করে, বাংলা ভাষায় না করে হিন্দিতে কেন করছিলেন? অঞ্জন দত্ত: কারণ আমার মনে হয়েছিলো যে আমি হিন্দি ছবি করতে পারি এবং হিন্দি ছবি বেশি মানুষ কম্যুনিকেট করবে।
শি.সা: সেটা কি আপনার অভিনয়ের জন্য... অঞ্জন দত্ত: না না না না। ভালো হিন্দি ছবি দরকার এবং ইংরেজি ছবি করতে পারি, হিন্দি ছবি করতে পারি। কলকাতায় থেকে বাংলাই যে করতে হবে তার কোন মানে নেই। কলকাতায় অজস্র রকমের মানুষ থাকে, অজস্রভাষা বলে। কলকাতায় থেকেও হিন্দি ছবি করা যায়। এবং আমি ছবিটা করেছিলাম, এবং সিরিয়াস ছবি, শাবানা আজমী ছিলো—
শি.সা: শাবানা আজমী ছিলো রাইট। ইরফান খান ছিলো। অঞ্জন দত্ত: এবং এটা ইরফান খানের প্রথম ছবিও। ইরফান খানের পঁচিশ বছর বয়স হয়নি তখন।
পদ্মা: দাদা, এই প্রসঙ্গে একটু জানতে চাচ্ছি, বলিউডের সিনেমা মানে, আপনার কেন মনে হয়েছে যে বলিউডে ভালো একটা সিনেমা আপনি করতে চান? একটা ভালো হিন্দি সিনেমা করতে চান? অঞ্জন দত্ত: স্ট্রং ছবি করতে চেয়েছি—
শি.সা: স্ট্রং সিনেমা মানে.. পদ্মা: ভালো সিনেমাই কিন্তু ছিলো। শাবানা আজমির মত একজন অভিনেত্রী যেটাতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সিনেমাটা তো সে সময় দর্শকদের চাহিদাটা পূরণ করতে পারেনি। আপনার কি মনে হয়? অঞ্জন দত্ত: না না না। তখন দু ধরণের সিনেমা হতো, তখন হতো একেবারেই আর্ট সিনেমা, যে সিনেমা কেউ দেখে না। বিদেশে যায়, অ্যাওয়ার্ড পায়।
শি.সা: হা হা হা। অঞ্জন দত্ত: আর আরেকটা হচ্ছে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে। আমার ছবিটা যেদিন রিলিজ করেছিলো দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে ও সেদিন রিলিজ করেছিলো। তো দর্শক বুঝে উঠতে পারেনি যে এটা কি রকম ছবি। এটা একটা মিক্সড। যেমন তার মধ্যে এন্টারটেইনমেন্টও আছে আবার...
শি.সা: জীবনের গুঢ় সত্যের কথাও— অঞ্জন দত্ত: সত্যের প্রকাশও আছে। গানও আছে, আবার সিরিয়াস। এরকম ছবি তখন হতো না। আজকে বলিউডে কিন্তু এ সংখ্যক ছবি ম্যক্সিমাম দেখি।
শি.সা: এরকম ছবি হচ্ছে। অঞ্জন দত্ত: একটা সালমান খান বছরে, দু বছর অন্তর শাহরুখ খান, আর একটা নাম সঞ্জয় লীলা বনশালী বাদ দিলে, বা সাজিদ নাদিয়াদওয়ালা, এদের বাদ দিয়ে আপনি যে কোন ছবি দেখেন, হাইওয়ে, কুইন,লাঞ্চ বক্স, কাহানী, শাহিদ, যে কোন ছবি। অজস্র ছবি হচ্ছে যেগুলো বড়দিনের মত ছবি, আজকে ‘বড়দিন’ যদি রিলিজ করতো সাকসেস পেতো।
শি.সা: আপনি এটা মনে করেন? অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ। অবশ্যই মনে করি। আমার কলিগরা যারা— অনুরাগ বসু, বারফি-টারফি যারা বানাচ্ছে, আমার বন্ধু অনুরাগ কাশ্যপ—যারা বানাচ্ছে তাঁরা আমাকে নিজেরাই বলে, তুমি ছবিটা তখন এগিয়ে করেছো। এখন ছবিটা করলে...লাইফ ইন এ মেট্রো এরকম ছবি। ইরফান ইজ এ সুপারস্টার। নওয়াজ উদ্দিন সুপারস্টার, মানে হিউজ স্টার, হিউজ বক্স আপিল। কঙ্কনা সেন শর্মা, হিউজ বক্স আপীল, বলিউডে একটা হচ্ছে শাহরুখ, শাহরুখ শুধু বলিউড নয়, অল ওভার দ্যা ওয়ার্ল্ড নাম্বার ওয়ান এখন। সো কিন্তু এই ধরণের ছবির বিরাট একটা চাহিদা আছে, হয়তো বড়দিন সময় থেকে এগিয়ে ছিলো।
শি.সা: আপনি এটা মনে করেন? এরপর আপনি আর ছবি তাহলে হিন্দী ছবি— অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ, তারপরেও আমি একটা হিন্দি ছবি করেছি, নাসিরউদ্দিন, কে কে মেনন, জিমি শেরগিল এদের নিয়ে, BBD বলে, সেটা পারফেক্ট পিকচার কোম্পানি তৈরি করেছিলো, কিন্তু যে কোম্পানি তৈরি করেছিলো, কিন্তু সেই কোম্পানি এখন কিনে নিয়েছে বোধ হয় অন্য কোম্পানি। সেটা এখন এই জালেই আটকে আছে। এই কোম্পানিকে যখন এটা, ভালো অন্য একটা কোম্পানি কিনে নেবে—
শি.সা: তখন রিলিজ হবে? অঞ্জন দত্ত: তখন হয়তো রিলিজ হবে।
শি.সা: এরপর আপনি বাংলা সিনেমা বানিয়েছেন। সিনেমার কথায় গেলে, আপনার আসলে বর্নাঢ্য ক্যারিয়ার। আমি আইএমডিবি দেখছিলাম যে অঞ্জন দত্তের কি কি ছবি। কোনটা দেখা আর কোন চলচ্চিত্রটা দেখা হলো না। তো মানে মৃণাল সেনের সাথে আপনার পরিচয়ের দিনটার কথা যদি আপনি আমাদেরকে বলেন? মানে, তিনি বোধ হয় আপনাকে, আপনার অভিনয়ের যে প্রতিভা, আপনি একজন ভালো অভিনেতা এটা প্রথম মেনশন করেছিলেন তিনি।
অঞ্জন দত্ত: আমি একটা বাচ্চা ছেলে তখন, আমি অভিনয় করতে চাইছি, আমি থিয়েটার করেছিলাম বহুদিন। আমি বার্লিনে তিন বছর থিয়েটার করেছি, যাই হোক আমি সেটা পরে, আমি থিয়েটার করছি,বাদল সরকারের হাতে আমি তৈরি। as an actor তিনি আমাকে ট্রেইন করেছেন।
শি.সা: রাইট। অঞ্জন দত্ত: কিন্তু আমি ছবি করার সুযোগ পাচ্ছি না, আমি তাই থিয়েটার করতাম। থিয়েটারের একটা কাজেই, একটা ফরাসী নাটকের কাজেই, আমি একটা ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বেসিতে গিয়েছিলাম স্পন্সরের ব্যাপারে ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করতে, তখন আমার বয়েস একুশ না, বাইশ এরকম, আমি থিয়েটার তখন করছি, নির্দেশনা দিচ্ছি, আমার তখন একটা ছোটদলও আছে, দুটা নাটক করেছি, সেই ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বেসিতেমৃণাল সেন এসেছিলেন, একদিন প্রতিদিন ছবিটার সাব টাইটেল, ফরাসী সাবটাইটেল এর ব্যাপারেতিনি এসেছিলেন। আমি একটা কোণে বসে বসে গাঁজা খাচ্ছিলাম। এতবড় একটা লোক বসে আছে, তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেন, আমি উনার সঙ্গে কথা বলি। আমি পরে বুঝতে পারি, মানে কথা-টথা বলে পরে বুঝতে পারি যে উনি মৃণাল সেন। তখন আমি একটা খবরের কাগজে চাকরি করতাম । তার একবছর পর মৃণাল সেন আমাকে খোঁজ করতে শুরু করলেন। সবাই বললো, তোমাকে মৃণাল সেন খুঁজছেন। তখন আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। যা হবার হবে।থিয়েটার টিয়েটার করছি। বার্লিন যাবো ভাবছি, বার্লিন যাবার একটা চান্স এসেছে ভাবছি যাবো কি না যাবো কি না। মৃণাল সেন খোঁজ করছেন তাঁর ছবির নায়ক বানাবার জন্য, মৃণাল সেন বললেন, ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বেসিতে বসে ছিলো একটা ছেলে, ঐ ছেলেটা কে? ওকে আমার চাই। খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে, পেলো আমাকে, মৃণাল সেন, রিহার্সেলে ডাকলো আমাকে, এবং আমাকে বললো, “তুমি সিনেমায় নামবে?”আমি রাজী হয়ে গেলাম। আমি সিনেমার মোহে পড়ে গেলাম, অভিনয় করলাম, ছবিটা বোম্বেতে গেলো, আমি একটা পুরষ্কার পেলাম।
শি.সা: এবং প্রথম চলচ্চিত্রে পুরষ্কার পাওয়া। অঞ্জন দত্ত: বেস্ট এক্টর অ্যাওয়ার্ড ফ্রম ভেনিস চলচ্চিত্র।
শি.সা: এটা কি মানে গান থেকে আপনার মনোযোগ কিছুটা হলেও কি এই ঘটনা সরিয়ে দিলো? অঞ্জনদত্ত: মানে গান করছি না আমি তখন…
শি.সা: চুরানব্বইতে আপনার প্রথম অ্যালবাম বেরুলো? অঞ্জন দত্ত: এটা বলছি আমি নাইনটিন সেভেনটি নাইনের কথা। সেভেনটি নাইন, আমি গানটান করছি না তখন। মৃণাল সেন নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুটিং শুরু হবার আগেই বুদ্ধদেব বাবু খবর পেয়ে, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বললেন যে, আমার ছবিতে নায়কের চরিত্র করতে হবে। এইবার আমি পর পর পর পর কিছু ছবিতে কাজ করলাম। বুদ্ধদেব, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ এবং আমি দেখলাম যে, এই মানে বাংলা টলিউড সিনেমার সঙ্গে, আমি ঐ সিনেমা আমি করতে পারবো না। আশির দশকের যে ছবি হতো। আমার এই মুষ্টিমেয় কিছু সিরিয়াস আর্ট ফিল্ম মেকারই আমার অভিনয়ে বুঝতে পারছে। টলিউড আমার অভিনয়টা বুঝতেই পারছে না বা আমার চেহারা বা হাবভাব বুঝতে পারছে না। তখন টলিউডের স্টার হচ্ছে তাপস পাল, মুনমুন সেন, প্রসেনজিৎ।
শি.সা: মানে জনপ্রিয় স্টার? অঞ্জন দত্ত: জনপ্রিয়তা। আর্ট সেক্টরে আমি তখন ইম্পরট্যান্ট, কলকাতার আর্টিস্টিক মহলে আমি ইম্পরট্যান্ট।
শি.সা: এই সিনেমাগুলো করেও কিন্তু আপনি আপনার বাবার দেনা শোধ করতে পারলেন না। অঞ্জন দত্ত: না। মৃণাল সেন আমায় পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তখনতো বাবা বেঁচে আছেন।আমার বাবা বেঁচে আছেন, বুদ্ধদেব বাবু আট হাজার, করতে করতে করতে করতে আমার শেষ ছবি অন্তহীনে মৃণাল দা আমায় দিয়েছিলেন, বোধ হয় আমার মনে হয় পঞ্চাশ হাজার, বুদ্ধ’র পঞ্চাশ হাজার, আমি পঞ্চাশ হাজার , ওরা তো এখন দশ লাখ টাকা, পঞ্চাশ হাজার তখন। অপর্ণা সেন তখন, তো এই করতে করতে অনেকদিন পরে—
শি.সা: অঞ্জন দা আপনার মানে চলচ্চিত্র গুলো... অঞ্জন দত্ত: আমি গান করে আমার একেকটি এ্যালবাম, পর পর চারটি এ্যালবাম । আমি কত টাকা গ্রহণ করি ঐগুলোতে?
শি.সা: মানে আপনার জীবনটা আমাদের কাছে এসেছে, আমরাতো আপনার প্রায় নখের বয়েসী। আমাদের কাছে এসেছে কিন্তু উল্টোভাবে। আমরা আগে আপনার গান শুনেছি, পরে আপনার চলচ্চিত্র দেখেছি। এখন আপনার টেলিফিল্ম টিল্ম সব কিছু মিলিয়ে দেখি, তো আপনি আপনার বাবার দেনা শোধ করলেন, বাবা তখনও বেঁচে আছেন— অঞ্জন দত্ত: বাবা মারা গেছেন।
শি.সা: মারা যাবার পরে গান করে, চুরানব্বইতে যখন আপনার প্রথম এ্যালবাম বেরুলো, ‘শুনতে কি চাও ?’ অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ। ‘শুনতে কি চাও’।
শি.সা: শুনতে কি চাও এবং সেই এ্যালবামটা মানে আপনাকে আসলে কি কি উপলব্ধি দিলো? প্রথম এ্যালবাম। অঞ্জন দত্ত: না আমি দেখুন, আমি করেছিলাম বিকজ আমিতো এটা করে টলিউডে হিরো হতে পারবো না। আর কিছু মুষ্টিমেয় ডিরেক্টরের উপর বেঁচে থেকে, আমার চলবে না। এটা আমার জন্যে ইনসিকিউরড। আর এটা প্রতিবছর, পর পর সবাই মিলে আমাকে যে, এরা বছরে হয়তো একটা ছবি করছে, তো বছরে আমি একটা পাচ্ছি, দেড় খানা পাচ্ছি। টাকা আমায় রোজগার করতে হবে। দশ হাজার, পনেরো হাজার টাকা দিয়ে তো আমার সারাবছর হবে না। তখন আমি ডিসাইড করলাম যে, আমি ডিরেকশনে যাবো, ডিরেকশনে দিতে হবে আমাকে। কিন্তু ডিরেকশন আমি কি করে দেবো? আমি, আমার জানতে হবে, ডিরেকশনটা কি? এর একটা মানে ডিরেকশান নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার, ডিরেকশন মানে ছবি ডিরেকশন নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার, সময় তো লাগবে। বাঁচার জন্য এমনি সব খরচা মানে পকেট মানি , কোন পকেটমানি করা যায় কি না, আমি পকেটমানির জন্য এবং পকেটমানির জন্য আমি গানটা করলাম।
..........................................................................
শি.সা: কি নির্মম একটা বাস্তবতা চিন্তা করেছো?পদ্মা: ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। আপনার গান শুনলে বোঝা যায়, এই সবকিছুর প্রভাব আছে গানের লিরিকে...অঞ্জন দত্ত: হু। এর জন্যে গানটা আমাকে হিউজ, আ... নাইনটি থ্রি, নাইনটি ফোর, নাইনটি ফাইভ, নাইনটি সিক্স, নাইনটি সেভেন, সে সময় এক একটা শো আই আর্নড এ হিউজ অ্যামাউন্ট অব মানি।
শি.সা: অঞ্জন দা আপনার গানের একেকটা কথা, সেগুলো তো মানে, গীতিকবিতা, মানে সুর যদি বাদ দিই-ও, দুর্দান্ত সব কবিতা এবং আপনার সময়ে কবিতা যারা লিখছেন, আপনার সমসাময়িক যারা, যারা অনেকেই অনেক বিখ্যাত, তাঁদের অনেক বিখ্যাত কবিতাতেও আপনার গানের অনেক শব্দ, অনেক বাক্য, অনেক লাইন ঢুকে পড়ার উদাহরণ আছে। অনেক স্ট্রং, অনেক নাড়া দিয়ে যায় আপনার গান।
পদ্মা: গানগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য হলো অনেক সহজ যেটা মানুষ সহজেই ক্যাচ করতে পারে। শি.সা: আপনার কখনও কবি খ্যাতি পাওয়ার ইচ্ছা হয়নি? অঞ্জন দত্ত: না, আমার কখনো মনে হয়নি কবিতা পারবো। বা লেখক হবার ইচ্ছে ইদানীং হচ্ছে,মানে লেখা, বই লেখা। কিন্তু আমিতো নিজের স্ক্রিপ্ট নিজেই লিখি। কিন্তু সে জায়গা থেকে কবিতা কখনো আমার মনে আসেনি গানের মধ্যে দিয়েই এসেছে এবং সেই সময় আমি, সুমন প্রথম, তারপর আমি, নচিকেতা, আমরা তিনজনই একটা হিউজ পরিবর্তন আনলাম।
শি.সা: বাংলা গানের। অঞ্জন দত্ত: বাংলা গানের পরিবর্তন। তারপরে জেনারেশান আবার ব্যান্ড এলো তারপর।
শি.সা: না আমি জানতে চাচ্ছিলাম যেমন আপনার গানের কথার মধ্যে আছে, মেঘ দেখে বললো মানে ঐ বাচ্চাটা যখন ভাবছে বা বাবা মা তাকে রেখে গেছে, একা একা সে খেলছে এই যে জায়গা গুলি ভয়ংকর রকম স্ট্রং। আমার খুব প্রিয় একটা গান আছে, দুটো মানুষ একসাথে কত পথ চলা, হাতে হাত রেখে কথা বলা...
পদ্মা: এতো কবিতাই দাদা?
শি.সা: আপনি পরে সুর দিয়ে গীটার বাজিয়ে গাইছেন কিন্তু আপনার ভক্ত যারা তাদেরতো হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করছে পুরো বিষয়টা এবং আপনার কি মনে হয় না কখনও যে আপনি এত ভার্সেটাইল কাজ করার মধ্য দিয়ে আপনার মানে আসল যে ক্ষমতা লেখনী, মানুষের হৃদয়কে ছোঁয়ার, তাকে আসলে অবহেলা করেছেন? অঞ্জন দত্ত: না না না। আমার মনে হয় আমার গানে এসেছে, তা ব্যবহার করেছি। গান বেশি লোক শোনে ও কবিতা যারা পড়ে তার থেকে গান শুনে বেশি। আমি অনেক বেশি মানুষের কাছে রিচ করেছি পরবর্তিকালে প্রত্যেকটা স্ক্রিপ্ট আমার আমি নিজে লিখেছি। তো স্ক্রিপ্টটা ওতো একটা লিখা।
শি.সা: হ্যাঁ অবশ্যই।অঞ্জন দত্ত: আমার ছবির গান নিয়ে নীল দত্ত মাঝে মাঝে বলে যে, এই গানটা তুমি লিখে দাও। আমি গান লিখি। গানও লিখে দিয়েছি, এমন নয় যে গান লিখা বন্ধ করেছি। বং কানেকশনের গান, ম্যাডলি বাঙালির দুটো গান লিখেছি, রঞ্জনা আমার পুরনো গান, একটা দুটা আছে, এই গানটা আমার লিখা, দত্ত ভার্সেস দত্ত এর গানটা। গানতো আমি লিখি।
শি.সা: আপনার নাটকে যাই আমরা, বাদল সরকারের দলে আপনি কাজ করতেন...অঞ্জন দত্ত: না বাদল সরকারের দল নয়, বাদল সরকার উনি অভিনেতা ট্রেইন করতেন। তিনি দল চালাতেন যেরকম, তিনি পয়সা নিয়ে শেখাতেন।
শি.সা: আপনারও তো দল ছিলো? অঞ্জন দত্ত: আমার একটা ছোট দল ছিলো। কিন্তু তাঁর কাছে আমি শিখতে গিয়েছিলাম। অভিনয় শিখতে। তিনি ট্রেইন করেছেন আমায়।
শি.সা: আপনার যৌবনে আপনি কোন বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন?অঞ্জন দত্ত: না আমি কোনদিন ছিলাম না কিন্তু আমার অজস্র বন্ধু ছিলো। অজস্র বন্ধু বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলো।
পদ্মা: আপনার অনেক ছবিতে কিন্তু ব্যাপারটা এসেছে, আপনার চরিত্ররা বামপন্থী হয়।
‘আবার ব্যোমকেশ’ ছবির শুটিংয়ে শাশ্বত’র সাথে অঞ্জন...
শি.সা: কলকাতার বাস্তবতায় সেটা ছিলো। এই সময়কার বাস্তবতায় সেটা ধরতে চেয়েছেন? অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ আমি দার্জিলিং এর পড়াশোনা করাটা ছেড়ে কলকাতায় এসে কমপ্লিটলি খেই হারিয়ে ফেলি। আমার একদিকে একটা ভীতির জগত ছিলও। রক এন্ড রোল মিউজিকের জগত ছিলো এবং পার্ক-স্ট্রীটের গানের জগত ছিলো।
শি.সা: রবীন্দ্র সঙ্গীতের জগত ছিলো!অঞ্জন দত্ত: রবীন্দ্র সঙ্গীতটা আমার কাছে অনেক পরে এসেছে। আমার কাছে সে সময় রবীন্দ্র সঙ্গীতের জগতটা ছিলো না। আমার কাছে পশ্চিমা একটা ব্যাপার ছিলো। প্রতিবাদী মিউজিক হচ্ছে রক মিউজিক, রক মিউজিক তো প্রতিবাদী মিউজিক, রক মিউজিক এইটাই ইস্যু ছিলো আমার কাছে।
পদ্মা: হুম হুম। আপনার গানে সেটার রেশ পাওয়া যায়।অঞ্জন দত্ত: বব ডিলানের গান শুনেছি, বুঝতে পেরেছি প্রতিটি কথা। ভিয়েতনামী যুদ্ধ এবং সেই সূত্রে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ। এক বন্ধু হিসেবে, আমি কোনদিন উগ্র ভায়োলেন্ট, হিংসার রাজনীতি, কোন রাজনীতিতেই বিশ্বাস করি না। হিংসাতে বিশ্বাসই করি না কিন্তু আমার বন্ধুরা ছিলো, তাঁরা বিশ্বাস করতো, তাদের সময়-অসময়ে দরকারে, প্রয়োজনে টাকা লেগেছে, দিয়েছি। বাবা ঘোর কংগ্রেস, কিন্তু বাবা সেসব জানতেন না। বই পত্র লুকিয়ে রাখা হতো, আমার বাড়িতে মাঝে মাঝে সেটা লুকিয়ে রাখতাম। বন্ধু বান্ধব আসতো, এক রাত থেকে চলে যেতো। বন্ধু বলে, রাজনীতিক বলে নয়। তারা যে বন্ধুই হোক, তারা ডানপন্থী বন্ধু হলেও তারা আমার বাড়িতে থাকতে পারতো । আমার কাছে বন্ধুত্ব রাজনীতি থেকেও অনেক বড়। এই তাঁরা রাজনীতি করে বলে নয়, তাঁরা আমার বন্ধু বলে ।
শি.সা: আপনি গাইছেন, ছন্দা আই এম রাইটিং দিস লেটার টু ইউ ... ঐ গানটা, হ্যাপি বার্থ ডে। ছন্দা দির সাথে আপনার পরিচয় কিভাবে হলো যদি আমাদের একটু বলেন। অঞ্জন দত্ত: ইউনিভার্সিটি জীবনে আমাদের দেখা। ওঁ মিয়ানমারে বড় হয়েছে। মিয়ানমারে জন্মেছে। মিয়ানমারে বড় হয়েছি, অনেক বড় বয়সে, মিয়ানমারের পাহাড়ে, টাউনজি পাহাড়ে বার্মার, আমি ওখানে বড় হয়েছি।
শি.সা: রেঙ্গুন?অঞ্জনদত্ত: রেঙ্গুন থেকে আরও দূরে, পাহাড়ে। আমিও পাহাড়ে বড় হয়েছি দার্জিলিং এ। আমাদের দেখা হয় ইউনিভার্সিটিতে, ইংলিশে এম এ পড়ছি, আমাদের দেখা হয়। এবং আমাদের ভালো লাগা, গান, হিহি,রক এন্ড রোল এই জায়গা থেকে আমাদের এক সম্পর্ক তৈরি হয়। এবং আমরা বিয়ে করে ফেলি খুব অল্প বয়সে। এই আমাদের যোগাযোগ । তারপর থেকে ওঁ পড়িয়েছে, নাটক করেছে আমার সঙ্গে, ওঁর জগত চলেছে, আমার জগত চলেছে এবং আমরা দুজন দুজনকে স্পেস দিয়েছি। এমন নয় যে আমরা...... বাট অনেক ছুটতে হয়েছে আমাকে, অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে। মানে আমি ঠিক সংসার করতে পারিনি।
শি.সা: সংসারটা তিনিই করেছেন? অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ। ছন্দা সে দায়িত্বটা নিয়ে সংসার টাকে ধরে রেখেছে, ছেলেমেয়েগুলোকে মানুষ করেছে, পড়িয়েছে, নীলকে গিটার শিখিয়েছে, আমি শেখাই নি। জার্মানি চলে গেলাম তিন বছর, বিয়ে করার পরেই। তিন বছর ছিলাম না তরপর আবার ফিরে এলাম, নীল জন্মালো। অ্যামেরিকা চলে গেলাম এক বছর, আরও পরে নাইনটি ওয়ান থেকে নাইনটি টু। এইযে নানা রকম কিছু। ফিরে এসে নাইনটি ফোরে গান করলাম। একটা আনসারটেইন সময় গেছে। তো এই সংসারটাকে ধরে রাখা, আমাদের, বাচ্চাদেরকে এবং আমাকে নিয়ে ধরে রাখাটা ছন্দার। সেটা আমার মনে হয়এবং আমাদের বড় হওয়ার মধ্যে বন্ধুত্বটা খুব রোল প্লে করেছে। বন্ধুত্বটা খুব ইম্পরট্যান্ট বলে বিশ্বাস করেছিলাম।
শি.সা: আপনি বলেন যে, ছন্দাদি আসলে একভাবে সেক্রিফাইস করেছে তার জীবন আপনার জন্য। অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ আমার মনে হয় প্রত্যেক মানুষের জীবনেই সেটা হয়। একজনকে ছাড়তে হয়। সেক্রিফাইস ছন্দা কখনও মনে করে না। হ্যাঁ আমি মনে করি যে ছন্দা অন্য কিছু করতে পারতো। আরও হয়তো অন্য কিছু করতে পারতো। এয়ারহোস্টেস হবার ইচ্ছে ছিলো ওর। হয়তো হয়নি এয়ার হোস্টেস আমার জন্যই। কিন্তু পরবর্তিকালে আবার আমি যে সিকিউরিটিটা ওকে দিয়েছি, সে সিকুইরিটিটা আমি জানি না, কোথাও গিয়ে একটা সময় সে আমার পাশে অসম্ভব দাঁড়িয়েছিলো আরও একটা আমি আবার,ওকে এমন একটা জায়গা দিতে পেরেছি। আমি আর নীল দুজনে মিলে, ওকে আর ভাবতে হয় না। ও জানে যে হ্যাঁ আজ অঞ্জন, নীল আছে, আই এম দেয়ার। সেইটা আর কি। তবে আমার গড়ে উঠার পেছনে ছন্দার একটা অবদান আছে।
শি.সা: মানে আপনি যখন আপনার পড়াশোনা শেষ করলেন মানে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা যখন শেষ করলেন সেই সময় এবং এই সময় যদি মিলিয়ে দেখেন, আপনার জীবনের দিকে যদি ফিরে তাকান, আপনি... কি মনে হয়, যা যা করতে চেয়েছিলেন, যা যা চেয়েছিলেন জীবনের কাছে, পেয়েছেন? অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ আমি এটাই করতে চেয়েছিলাম এবং এটাই করতে চাইবো, আমি এক্টিং করতে চেয়েছি, সিনেমা করতে পেরেছি, গানটা চলে এসছে, আমি কিন্তু একটা ক্রিয়েটিভ শিল্পী হতে চেয়েছি , আমি কখনও তেমন একটা নিজেকে বিকিয়ে দেইনি। বিজ্ঞাপনের চাকরি টাকরি ও করেছি কিন্তু আমি কর্পোরেট লাইফ কখনও চাইনি। অফিস যেতে চাইনি। আমি একটা নিজের মতন বাঁচতে চেয়েছি। সেটার জন্যে কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে, অনেক। একসময় মা সোয়েটার বুনে দিতো আমি গিয়ে ওটা বিক্রি করে আসতাম। বাবার অবস্থা খুব খারাপ। খুব বড়লোক ফ্যামিলির ছেলে আমি, কিন্তু সেই ফ্যামিলিটা সত্তরের দশক থেকে হুড়মুড় হুড়মুড় করে পড়ে গেলো। মানে কলাপস করে বসলো, দত্ত ভার্সেস দত্ত আমার জীবনের খুব কাছের।
পদ্মা: হ্যাঁ। আপনি বলেছেন আপনার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত।অঞ্জন দত্ত: আমার জীবনে খুব চাপ ছিলো তো...
শি.সা: মানে এই পড়ে যাওয়ার সাথে... অঞ্জন দত্ত: মানে আমরা খুব প্রাউড একটা ফ্যামিলি। বাবুয়ানিতে যেমন।
শি.সা: রাইট... অঞ্জন দত্ত: বাবুয়ানা...
শি.সা: টাকা নেই তবু বাবুয়ানা।অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ। সে এমন করে অনেক কিছু দেখেছি, চূড়ান্ত বড়লোকীপনা দেখেছি। আবার সেখান থেকে চূড়ান্ত দারিদ্র্য আমি দেখেছি। তারপর পরবর্তিকালে যখন স্ট্রাগল করেছি, নাটক করেছি, ছন্দার বিয়ের গয়না বিক্রি করতে হয়েছে। কারণ আমি চেয়েছি এ রাস্তাটা। আমি চেয়েছি এটা করবো, আমি জানতাম আমি এটা করতে পারবো। সেটা করেছিও। আজ অব্দি ছন্দাতো আফসোস করে না যে গয়নাটা। তার মানে নয় যে আমি আর গয়না গড়ে দিচ্ছি না। কিন্তু...
শি.সা: বিয়ের গয়না মানে আলাদা মাহাত্ম্য বহন করে। অঞ্জন দত্ত: হ্যাঁ। তবু ও দিয়েছে, না দিতেই পারতো, বলতে না আমার বিয়ের গয়না আমি তোমায় দেবো কেন? কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো যে, দিয়ে দাও আমি আর পারছি না আমাকে, গিভ মি টাইম। মুঠো করে দিয়ে দিয়েছে। বলেছি টাইম দাও আমায়, সুতরাং আমি দারিদ্র্য’র মধ্য দিয়েও গেছি।
পদ্মা: দাদা একটা জিনিস কিন্তু আপনি বলেন প্রায়ই, আজকেও বললেন যে, গানটা আপনার লাইফে চলে এসেছে। মানে কি, গানটা করতে চান নি?অঞ্জন দত্ত: না। গানটা আমি ছোটবেলা থেকেই গিটার বাজাচ্ছি। দার্জিলিং-এর অধিকাংশ মানুষই গিটার বাজায়। ছোটবেলা থেকেই গিটার বাজাচ্ছি। ছোটবেলা থেকেই হিন্দি গান গাইছি। কিন্তু এটা আমার একটা প্যাশন ছিলো । মনে মনে কিন্তু একটা দুটো সুমন ছিলো। গান করতে চাইনি, তা না। তবে অভিনয়টা চেয়েছি। আমি যদি প্রকাশ্যে গান না ও করতাম, হয়তো আমি এই গানগুলো নিজের জন্য করতাম। বাড়িতে সারাক্ষণ গিটার বাজাচ্ছি, গান করছি, কলেজে গাইছি, গাইছি, অমুক করছি, তমুক করছি। আমি সবসময় করছি। আমি চাকরিতে কাজ করতাম, আমি থিয়েটার করতাম, আমি অভিনয় ছাড়তাম না। কিন্তু গানটা আমার ছিলো, কিন্তু গানটা আমার এতটা থাকবে,সে ভাবে আমি বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম সিনেমাতে হয়ে যাবে। কিন্তু গানটা আমাকে অনেক সাকসেস দিয়েছে, আমার বং কানেকশন যখন হিট হয়ে গেলো তখন আমার গানের সাকসেসের প্রয়োজন ছিলো না, মানে তখন গান না হলেও চলে। শি.সা: হুম... অঞ্জন দত্ত: কিন্তু প্রোগ্রাম হচ্ছে আমি করছি।
শি.সা: দাদা আপনার তো আর্ট ফিল্ম দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। দীর্ঘ সময় আপনি আর্ট ফিল্ম এ অভিনয় করলেন। তারপর গান এলো। এবং এখন আমি যেই সিনেমা বানাচ্ছেন, আমি সর্বশেষ আমরা গণেশ টকিজ দেখলাম। যে আপনি একটা ব্যাপক আইটেম সং ব্যবহার করেছেন, ‘তোমার ঝাল লেগেছে, আমার ঝাল লেগেছে’, এবং এটাও কিন্তু সেই আর্ট সিনেমা এবং এই মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, এই বিষয়গুলোই আছে। প্রেম এবং মজার বিষয় হলো চাচার সাথে ভাতিজীর প্রেম, এবং চাচা আবার...।
পদ্মা: ওটা আরেকটা,ওটা দত্ত ভার্সেস দত্ত। শি.সা: আমিতো গণেশটকিজের কথা বলছি।
পদ্মা: গনেশ টকিজের অন্য ধরণের কাহিনী। আইটেম সঙ ছিলো। বাট তুমি দুটা গুলিয়ে ফেলছো। অঞ্জন দত্ত: আ হুমম। আইটেম সঙের টা গনেশ টকিজ। আর প্রেমের টানাপোড়েনের টা দত্ত ভার্সেস দত্ত।
শি.সা: ও আচ্ছা।
পদ্মা: বলছিলাম যে, আপনি কেন আর্ট ফিল্মের দিকে এলেন? মানে আপনি বলছিলেন যে, হ্যাঁ আমি চেয়েছিলাম আর্ট ফিল্ম করতে। অঞ্জন দত্ত: না ঠিক আর্ট ফিল্ম না। আমি চেয়েছিলাম এই মেশাতে। মানে আমি এন্টারটেইনমেন্ট, মনোরঞ্জন এবং রুচিবোধটাকে মিলিয়ে এক ধরণের সিনেমা করতে চেয়েছিলাম। যেটার কোন দর্শক ছিলো না তখন।
শি.সা: আপনার কি মনে হয়, এখন সেই দর্শক তৈরি হয়েছে?অঞ্জন দত্ত: নিশ্চয়। কারণ আমার গানতো দুর্বোধ্যতো গান নয়। আমার গানতো যে কোন লোক ধরতে পারে, আমার গান আমি যেরকম লন্ডনে গাই, যে সব প্রত্যন্ত জায়গায়, বর্ধমান ছাড়িয়ে, গ্রামে গিয়েও গাইছি। লোকে শোনছে, তো আমার গানতো একটা দুর্বোধ্য, ইন্টেলেকচুয়াল, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নয় আমার গান। আমার গান পপুলার পপ মিউজিক। আধুনিক গান মানে এটাতো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নয়। তেমনি সিনেমাতে আমি অভিনয় করেছি এক সময়। আর্ট ফিল্ম দিয়ে আমার শুরু হয়েছে কিন্তু আমি যখন পরবর্তিকালে ‘বড়দিন’-এর পরে ওয়েট করেছিলাম, আট বছর ওয়েট করেছিলাম। যে একটা সময় যাক, আমি আমার মতনই ছবি করে যেতে হবে। আমি এর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কিছু করতে পারবো না। আমি তথাকথিত আর্ট ফিল্ম করবো না। অথচ আমি এন্টারটেইনিং ছবি করবো।
এই করে করে প্রায় আট বছর পর একজন ভদ্রলোক আমাকে এসে বললেন যে, আপনি একটা ছবি করবেন? বও ব্যারাকস ফরএভার, ছবি করবেন? ইংরেজি ছবি। আমি বললাম যে, হ্যাঁ করবো। কিন্তু ওটা আমার মত করে করতে হবে। Bow Barracks Forever ছবিটি আমি করলাম, ইন্টারন্যাশনালি একলেইমড হয়ে গেলো। বোম্বের এক প্রডিউসার কিনে নিলো। এবং ইট ওয়াজ বক্স অফিস হিট। কারণ ‘বও ব্যারাকস ফরএভার’ রিলিজ হয়েছে দু হাজার চার-এ। ২০০৪ কিন্তু মাল্টিপ্লেক্স মানে সিনেপ্লেক্স চলে এসছে, ২০০৪ এ কিন্তু লোকে একটা অন্যরকম সিনেমা দেখতে চাইছে। ২০০৪ এ শহরের মানুষ আর ঐ...
শি.সা: দিল ওয়ালে দুলহানিয়া অতটা দেখতে চাচ্ছে না? অঞ্জন দত্ত: দিল ওয়ালে দুলহানিয়া অতটা মানে তাঁরা একটু সিরিয়াস সিনেমার দর্শকরা, একটু অন্য রকম ছবি চাইছে। ইংরেজি সিনেমা যারা দেখে, আর্ট সিনেমা এবং কমার্শিয়াল সিনেমার বাইরে কিছু একটা দেখতে চাইছে। বং কানেকশন লেগে গেল যখন, ঋতুপর্ণ আমার আগে, ঋতুপর্ণ যেটা করলো, ঋতুপর্ণ ছবিতে এসে, সেটা হচ্ছে একটা মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত অডিয়েন্স হলে এসে সিনেমা দেখতে আরম্ভ করলো। ঋতুপর্ণ’র ছবিতো, প্রথমে যখন রিলিজ করেছিলো। ভুঁড়ি ভুঁড়ি এ্যাওয়ার্ড, ভুঁড়ি ভুঁড়ি কিছু পায়নি। কিন্তু একটা অডিয়েন্সকে হলে নিয়ে এলো আবার , যারা হল থেকে সরে গিয়েছিলো। স্বপন সাহা আর অঞ্জন চৌধুরী’র ছবির দর্শক গ্রামের লোকেরা,কিছু মনে করবেন না, অশিক্ষিত মানুষ দেখতো । অশিক্ষিত মানুষদের জন্যে অশিক্ষিত জিনিস দরকার।
শি.সা: সরল জিনিস দরকার। অঞ্জন দত্ত: আজকে তারা চামেলি দেখছে, তামিল তেলেগু সিনেমার রিমিক দেখছে। ওদের লজ্জাও নেই, তারা দেখছে। যারা করছে তাদেরও কোন লজ্জা নেই।
ডানে পদ্মা ও বামে শিমুলের সঙ্গে অঞ্জন দত্ত
আপনি কিন্তু সেই যে মধ্যবিত্ত বনেদী ফ্যামিলি আপনার ছিলো, সেরকম বনেদী একটা শিল্পবোধ থেকে এই কথা বলছেন যদি আমি বলি?অঞ্জন দত্ত: বলতে পারেন। হতে পারে কিন্তু বং কানেকশন যখন, এটা কিন্তু লোক আনলো। কিন্তু অল্প বয়েসী বাঙালি ছেলে মেয়েরা তারা মাল্টি সিনে প্লাক্সে যাচ্ছে না। হিন্দি সিনেমায় যাচ্ছে। তারা অতটা, আমি বলবো,বাবা, মা, মাসী, মেসো । আমি বলবো যে ঋতুপর্ণের অডিয়েন্স নাই। একদম অল্প বয়স্ক টুয়েন্টি ওয়ান, টুয়েন্টি টু, এইটিন, এমন না তারা হিন্দি ছবি দেখছে, ইংরেজি ছবি দেখছে, বাংলা ছবি দেখছে না, বাংলা ছবি দেখছে আমার গানের দর্শক যারা রঞ্জনা শুনলে লাফাচ্ছে, বেলা বোসকলেজে পড়ছে, এইখানে পড়ছে, তারা বাংলা সিনেমা বিলকুল দেখছে না। বং কানেকশন ছবিটা এই অডিয়েন্সটা নিয়ে এলো। তো এই মোড় ঘুরে গেলো। ঋতু প্রথম অডিয়েন্স নিয়ে এলো। আমি যেটা করলাম আমি অল্প বয়েসীদের আবার অডিয়েন্সে ঢুকিয়ে দিলাম। আমার অডিয়েন্স কিন্তু আমার গানের অডিয়েন্স, সিনেমার অডিয়েন্স এক। যারা আমার গান শুনে, তাঁরাই আমার সিনেমা দেখে। তথ্যসুত্র : বাংলামেইল২৪ নিউজপোর্টাল ৷
Comments