অসাম্প্রদায়িক মরমী সাধক‘লোকের রাজা’কে সশ্রদ্ধ সালাম।
ছবি : হাসন রাজা।
হাসন রাজার পুরো নাম দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী। জন্ম ২১ ডিসেম্বও ১৮৫৪ সালে। মৃত্যু ৬ ডিসেম্বর ১৯২২ সালে। তার পিতার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তাঁর তৃতীয় পুত্র। মাতা হুরমত জান বিবি। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বিশাল জামদারির উত্তরাধিকারী হন। হাছন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাঁদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাছন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তাঁরা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন।
হাসন রাজা বংশের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে আরবী এবং পরে বাংলা শিক্ষা লাভ করেন। সে সময় মুসলমান সমাজে ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন না থাকায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তার বেশী দূর এগোয়নি। স্বশিক্ষিত এই রাজা ছিলেন একজন শিক্ষা অনুরাগী। সুনামগঞ্জের প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীতে তার অবদান ছিল। সুনামগঞ্জ জুবিলি হাই স্কুল ও কলেজে জায়গা প্রদান তার অন্যতম। তৎকালীন রাজা, জমিদারদের ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায় শাষণ, শোষণ আর প্রজা নিপিড়নের কাহিনী। রাজা-প্রজার মধ্যে সম্পর্ক ছিল শোষক আর শোষিতের। যে কজন রাজা প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করেছেন হাসন রাজা তাদের একজন। আমাদের ইতিহাসে তিনিই বোধহয় একমাত্র রাজা যিনি সবসময় প্রজা পরিষ্টেত হয়ে থাকতেন। কারণ তলোয়ার দিয়ে তিনি রাজা হননি, হয়েছেন সুর আর গান দিয়ে। যদিও বংশানুক্রমে তিনি ছিলেন রাজ বংশের উত্তরাধিকার। কিন্তু গানের জন্য তিনি আজও বেঁচে আছেন মানুষের মনে ’লোকের রাজা’ হয়ে। ’লোক’ বলতে এখানে দ্বিমাত্রিক ব্যজ্ঞনা দেয়া হয়েছে। ’লোক’ মানে জনগনের রাজা ছিলেন। অন্যদিকে লোকের রাজা মানে তিনি লোকসাহিত্যের রাজা। হাসন রাজা নৃত্য গীতে সর্বদা বিভোর হয়ে থাকতেন। কখনো বাড়ির বাইরে গানের আসরের ঘরে, কখনো পানশী নৌকায় করে সুরমা নদীতে, কখনোবা অচিন্তপুরের সাহেরের ভিটে টিলায়, আবার কখনো সদরগড়ের সবুজ গাছ-গাছালি পরিবেষ্টিত জলাশয়ে নৌকার মাঝখানে। মাঝে মাঝে তিনি আবেগআপ্লুত হয়ে নিজের কোলে টেনে নিতেন প্রিয় ঢোলটি এবং স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে বাজাতে খাকতেন।
অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই বিশাল জমিদার বাস করতেন মাটির ঘরে। নিজের ঘরবাড়ী সম্পর্কে একটি গানে তিনি বলেছেন- লোকে বলে, বলেরে ঘরবাড়ী বালা না আমার, কি ঘর বানাইমু আমি শুন্যের মাঝার। প্রভাত কুমার শর্মার লেখা থেকে পাওয়া যায় তার ঘরবাড়ী সম্পর্কে একটি সুন্দর ঘটনা। একবার কয়েকজন বিদেশী ভদ্রলোক হাসন রাজার বাড়ী দেখতে এসেছিলেন। বাড়ীর সামনে তারা দেখা পায় হাসন রাজার । রাজা জানতে চাইলেন কি চান ? ভদ্রলোকগন তাকে না চিনে বললেন- আমরা হাসন রাজার বাড়ী দেখতে এসেছি। হাসন রাজা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বললেন 'আসুন আসুন আমি আপনাদের হাসন রাজার বাড়ী দেখাই'। এই বলে তিনি তাদের মাঠের মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখানে এই সাধকের কবর তৈরী হচ্ছিল। সেই চিরদিনকার বাড়ীর দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে দেখালেন - ঐ দেখুন আমার বাড়ী। হাসন রাজার যেমন বিলাসী তেমনি বৈরাগীও ছিলেন। মুক্ত হস্তে দান করতেন তিনি। তার এক মজার শখ ছিল ছোট ছোট বাচ্চাদের জড়ো করে রুপোর টাকা ছড়িয়ে দেয়া। বাচ্চরা হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত, তা দেখে খুব মজা পেতেন তিনি। হাসন রাজা ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ । পশু পাখী ভালবাসতেন । ঘোড়া ও কুড়া পাখির প্রতি তার আসক্তি ছিল বেশী। তার হাতি শালায় ছিল হাতি এবং ঘোড়া শালায় ঘোড়া । তার সংরক্ষিত ১৭৮ টি কুড়া পাখির নাম, ৮০ টি ঘোড়া এবং ৯টি হাতির নাম এখন হাসন রাজা মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে। অশ্বারহনে সুপটু এই রাজা জীবনে অনেকবার সিলেট, হবিগজ্ঞ, ঢাকা এমনকি কলকাতায় ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করেছেন। হাসন রাজা রচনা করেছেন দেহতত্ব, মুর্শিদি, সারি, প্রেম ও দেশাত্বোবোধক গান । হাসন রাজার সাথে কাব্য আর দর্শণ এক হয়ে মিশে আছে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা এবং বড় ভাইকে হারিয়ে তার নিজের মধ্যেও মৃত্যু চিন্তা ভর করে। তাই তার রচিত মরমী গানের অনেক অংশ জুড়েই রয়েছে আধ্রাতিক সাধনা ও পারলৌকিক চিন্তার প্রতিফলন। তাইতো তার কন্ঠে বেজেছে ’আমি যাইমু রে যাইমু আল্লারও সঙ্গে বা একদিন তোর হইবোরে মরণ রে হাসন রাজা- এই রকম অসংখ্য গান। অত্যন্ত তীক্ষ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই সাধক তার গানে নিজেকে উল্লেখ করেছেন বাঙালি হিসাবে। হাসন রাজা বাঙালি হয়ে কাঙ্গালী প্রেমানলে জ্বালিয়ে যায় প্রান আমি তোমার কাঙ্গালী গো সুন্দরী রাধা হাসন রাজা যখন গান লিখতেন অথবা গানের কলি, সুর এবং তাল মেলাতে ব্যস্ত থাকতেন, তখন তার চারপাশে পরিবেষ্টিত থাকত একদল সাদামাটা নারী-পুরুষ। এরাই তার গানের শব্দ, কলি এবং সুরে যথেষ্ট অবদান রাখতেন। তার কাব্যে অপূর্ব কবিত্ব শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ভাষা সহজ সরল হলেও তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। মরমী কবি হাসন রাজা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। তার আধুনিক দর্শণ আজও শেষ হয়ে যায়নি। তিনি মানুষের কবি মানবতার কবি। মানব প্রেম যুগে যুগে মহামানবে উন্মোচিত করেছে তাকে।
হাছন রাজা সর্বমোট বিয়ে করেন ছয়খানা। তবে একটি বিয়ে সাথে সাথেই ভেঙ্গে যায়। বাকী পাঁচ বিয়ের এক পক্ষে এক পুত্র সন্তান, আরেক পক্ষে দুই পুত্র সন্তান এবং অন্য এক পক্ষে এক পুত্র সন্তান জন্ম নেন। অর্থাৎ এই পাঁচ বিয়ের তিনটি থেকে চার পুত্র সন্তানের পিতা হন হাছন রাজা। তাঁর কণ্যা সন্তান ও ছিলেন চারজন। আট সন্তানের পিতা ছিলেন দেওয়ান হাছন রাজা ।
বর্তমানে রামপাশার সম্পত্তি তৃতীয় পুত্র সিলেটের প্রথম আধুনিক কবি হিসেবে স্বীকৃত দেওয়ান একলিমুর রাজার বংশের অধীনে রয়েছে। সুনামগঞ্জে হাছন রাজার বাড়ী হিসেবে খ্যাত লক্ষণশ্রী’র বাড়ীতে কনিষ্ট পুত্র দেওয়ান আফতাবুর রাজার বংশধর গন রয়েছেন। হাছন রাজার লক্ষণশ্রীর সেই বাড়ী থেকে প্রায় এক মাইলেরও কম দুরত্বে অবস্থিত হাছন নগরে বসবাস করেন দ্বিতীয় পুত্র দেওয়ান হাসিনুর রাজার বংশধরগন। প্রথম পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার কোন পুত্র সন্তান নেই। তবে প্রথম সন্তান দেওয়ান গনিউর রাজার এক কণ্যা সন্তানের স্বামী হচ্ছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। অবশ্য দেওয়ান মো: আজরফের মা হচ্ছেন হাছন রাজারই কণ্যা।
খুবই সুদর্শন, ফর্শা, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতা ছিল হাছন রাজার। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা বিশেষ স্টাইলে বাবরি কাটা চুল, পিঙ্গল চোখ, উন্নত নাসিকা এবং বহুল আলোচিত গোঁফ… হাছন রাজা বহু মানুষের ভিড়েও আলাদাভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। মানুষ, ঘোড়া, কুড়া’র প্রতি এক নজর দৃষ্টি বুলিয়ে বলে দিতে পারতেন, কেমন হবে এর স্বভাব চরিত্র। হাছন রাজার (১৮৫৪-১৯২২) মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৬৮ বৎসর।
হাছনরাজাকে কোথাও কোথাও বাউল শিল্পী বলে পরিচয় দিতে দেখি। হাছন রাজা কোন বাউল ছিলেন না। শিল্পী তো নয়ই। শিল্পী বললে তাঁকে অপমান বা অবমূল্যায়ন করা হয়। তিনি ছিলেন এর অনেক উর্ধ অবস্থান কারী এক মহান মরমী কবি। আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবনার এক মহান পতাকা বাহক ‘মরমী-রাজা’কে সশ্রদ্ধ সালাম।
হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণ
মরমী মহাজন হাছনরাজার জন্ম সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ার লক্ষণশ্রী-তে হলেও তাঁর পিতৃনিবাস সিলেটের বিশ্বনাথের রামপাশায়।
সুনামগঞ্জ শহরে ঢুকতেই চোখে পড়বে হাসন রাজা তোরণ। সুনামগঞ্জ বলতেই সর্ব প্রথমে আসে হাসন রাজার নাম। শহরের তেঘরিয়ায় এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
ছবিতে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বসত বাড়ি।
হাসন রাজার বাড়িতেই তার নামে মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রপৌত্র সামারীন দেওয়ান। দর্শনার্থী এবং পর্যটকদের কৌতুহল নিবৃত্তকল্পে হাসন রাজার ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বংশলতিকা ও অনান্য তথ্যাদি সম্বলিত দলিলাদি মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে। কালোত্তীর্ণ এ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতার ও গানের পাণ্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগাপ্লুত করে। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে তাঁর মায়ের কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়। তার এই কবরখানা তিনি মৃত্যুর পূর্বেই নিজে প্রস্তুত করেছিলেন।
বিশ্বনাথের সেই রামপাশা গ্রামে তার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ছাড়া তেমন কোনো স্মৃতি নেই।
চোখে পড়েনি তার একটি ছবি কিংবা গানের লিপিও। অযত্নে অবহেলায় পড়ে থেকে যেনো সেই গানের মতোই বিলাপ করছে হাছনের জন্মভিটা। স্মৃতি চিহ্নের অভাবে যেনো কাঁদছে তার যৌবন-বৃদ্ধে কাঁটানো পিঞ্জিরা। হাছন রাজার ঘরবাড়ি ছাড়া এখানে তার কোনো স্মৃতি নেই। সব সিলেটে ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’ এ রাখা হয়েছে।
‘মিউজিয়াম অব রাজাস’।
হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর, যার নাম ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’। ২০০৬ সালে রাজাদের পারিবারিক উদ্যোগে নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের জলারপারে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।
দুই কামরার পুরানো ভবনের বারান্দায় ১০ টাকা দর্শনীর বিনিময়ে টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয় জাদু ঘরের মূলকক্ষে। এর আগে, তাঁর বিখ্যাত কোন গানের অডিও আপনার কানে আসবে এবং যতক্ষণ এখানে থাকবেন শুনতেই থাকবেন ‘নেশা লাগিলরে’ মাটির ও পিঞ্জিরার মাঝে’ ‘কানাই তুমি খেইড় খেলাও কেনে’ ইত্যাদি সব বিখ্যাত গান। শুনতে শুনতে বাঁদিকের দেয়ালে চোখে পড়বে জন্ম মৃত্যুর তারিখ লেখা হাসন রাজার (১৮৫৪-১৯২২) ছবি। পশ্চিমের দেয়ালে পরিবারের সদস্যদের নামের তালিকা। এখানে দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা হাসন রাজা ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করেন। এখানে আছে হাছন রাজা ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র। আছে হাসন রাজা কে নিয়ে লেখা বইপত্র এবং পেপার কাটিংসের সংগ্রহ।
সামনেই চোখে পড়বে রাজ পরিবারের ব্যবহৃত একটি মাঝারি লোহার সিন্দুক। ইতিহাস সচেতন মানুষ হলে আপনি চলে যাবেন অনেক অনেক বছর আগে, যখন এই সিন্দুকই ছিল উচ্চবিত্ত শ্রেণির সম্পদ সংরক্ষনের পারিবারিক ব্যাংক এবং আভিজজাত্য প্রদর্শনের অন্যতম উপাদান। ডানদিকের কাঁচের মাঝারি বাক্সে সংরক্ষিত হাছন রাজা, রাজ পরিবার এবং এ জাদুঘর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদন। জাদুঘরে যা দেখতে পাবেন তা হলো, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহিত একতারা, দোতারা, প্লুং বাঁশি ইত্যাদি। আছে হাসন পরিবার ব্যবহৃত, থালা, জগ, প্লেট, কোরআন শরীফ রাখার রেহাল, ইস্ত্রি, সোনা ও রূপার তারের পোশাক, পাকিস্তান আমলের ধাতব মুদ্রা।
জাদুঘরে আপনার নজর কাড়বে হাসন রাজার বড় শখের পোষা কোড়াপাখির নামের তালিকা। তার ছিল কোড়া শিকারের প্রচন্ড নেশা। শিকারী জমিদার হাসন রাজার জীবনের কত বিনিদ্র রজনীইনা কেটেছে আজকের দিনে দুর্লভ এই কোড়া শিকারের নেশায়! আছে তার ৯টি হাতির নামের তালিকা। এদের নাম বেশ অভিজাত। জিবা, জঙ্গ- বাহাদুর, বাংলা বাহাদুর, মাসুকজান, মুকনা, রাজরানী, সুরতজান, মঙ্গলপ্যারি, হাছন প্যারি, ইত্যাদি। আরও আছে হাসন রাজার কাঠের তৈরি বগলা খড়ম, গুড়গুড়ি হুঁক্কা, ঘোড়ার পায়ের কাঠ, সেকালের কয়েকটা ইট, ইত্যাদি। পূর্বদিকের শোকেসে রাখা একতারা, ডোগী, ঢোলক, মৃদঙ্গ, ক্যাসেট এবং অনেক গুলো বাঁশি। হাসন রাজার ব্যবহার করা দুটি জোব্বা (বিশেষ ধরনের পাঞ্জাবী) । পরের কক্ষে আছে হাসন রাজার লেখা গানের বই এবং তাঁকে নিয়ে রচিত অনেক গুলো বই ও লিটল ম্যাগ। এখানে আরও আছে সৈয়দা মিনা রাজা কর্তৃক সংগৃহিত পৌণে ১ ইঞ্চি বাই ১ইঞ্চি কোরআন শরীফ যা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট কোরআন শরীফ গুলোর একটি বলে জানালেন জাদুঘরের একজন স্টাফ। সিলেটের মরমি শিল্পীদের নামের তালিকা সংযুক্তি জাদুঘরটির গুরুত্ব বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে সংস্কৃতিকর্মি ও গবেষকদের কাছে। জাদুঘরটি দেখতে দেখতে আপনার মন অনায়াসে ঘুরে আসবে সেকালের জমিদার বাড়ির সদর অন্দর। ------------------------------এক নজরে হাসন রাজা ------------------------------------ রবিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ০৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে মিউজিয়াম অব রাজাস।
নামঃ দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী ডাক নামঃ হাসন রাজা জন্ম তারিখঃ ৭ পৌষ ১২৬১ বাংলা (২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) উচ্চতাঃ ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি (১.৭৮ মিটার) জন্মস্থান/বসবাসঃ তেঘরিয়া (লক্ষণশ্রী), সুনামগঞ্জ (বৃহত্তর সিলেট) পৈত্রিক বাড়িঃ রামপাশা, বিশ্বনাথ, সিলেট মায়ের বাড়ি (নানার বাড়ি)ঃ খালিয়াজুড়ি, নেত্রকোনা (বৃহত্তর ময়মনসিংহ) পিতাঃ দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী (১২০৭-১২৭৬ বঙ্গাব্দ) (১৮০০-১৮৬৯ খ্রিঃ) মাতাঃ মোসাম্মত হুরমত জান বিবি (১২৩৫-১৩১০ বঙ্গাব্দ) (১৯২৮-১৯০৩ খ্রিঃ) ভাইঃ দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী (১৮৩২-১৮৬৯), দেওয়ান মোজাফ্ফর রাজা চৌধুরী (১৮৫২-১৮৭৯) বোনঃ সহিফা বানু (১৮৫০-১৯১৭) শখঃ গান রচনা ও গানের আসর জমানো, গায়কি দল নিয়ে নৌকা ভ্রমণ, নৌকা বাইচ, ঘোড় দৌড়, কোড়া ও অন্যান্য পাখি শিকার ও পালন, হাতির সোয়ারী হওয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। হাসন রাজার আর এক মজার শখ ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জড়ো করে রুপোর টাকা ছড়িয়ে দেওয়া। বাচ্চারা যখন হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত তা দেখে তিনি খুব মজা পেতেন। পড়াশুনাঃ বংশের নিয়মানুসারে তিনি প্রথমে আরবী এবং পরে বাংলা ভাষায় পাঠ শুরু করেন। হাসন রাজা যে যুগে জন্মেছিলেন সে যুগে মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষার তত প্রচলন না থাকায় বিদ্যালয়ের পড়াশুনায় তিনি বেশিদুর অগ্রসর হতে পারেন নি। নিজে আধুনিক শিক্ষায় বেশি অগ্রসর হতে না পারলেও শিক্ষা প্রসারে তিনি উদার হাতে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতেন। সুনামগঞ্জের প্রধান ক’টি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকল্পে তাঁর অফুরন্ত দান ছিল। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা প্রদান উল্লেখযোগ্য।
হাসন রাজার শারীরিক ধরণঃ হাসন রাজা সত্যিকার অর্থে সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর উচু দেহ, দীর্ঘ বাহু, ধারালো নাক এবং কোকড়ানো চুল প্রাচীন আর্যদের চেহারা স্মরণ করিয়ে দেয়। হাসন রাজার পোষাকের ধরণঃ সামগ্রিক ভাবে তাঁর পোষাক-পরিচ্ছদে ছিল আভিজ্যাত্যের পরিচয়। তিনি মখমলের চোগা, চাপকান ও জরির পাগড়ি ছাড়া বাইরে বের হতেন না। তাছাড়া লুঙ্গির মতো করে পেচিয়ে ধুতি ও হাতাওয়ালা গেঞ্জি নিয়মিত পরতেন। জমিদারিত্ব গ্রহণঃ ১২৭৬ বাংলা (১৮৬৯ খ্রিঃ) ১৫ বছর বয়সে যে বছরে হাসন রাজার বড় ভাই ও বাবা পরলোক গমন করেন। হাসন রাজার প্রথম রচিত বইঃ সৌখিন বাহার, রচনা কালঃ ১৮৬৫-১৮৬৯ খ্রিঃ), প্রকাশ কালঃ ১৯৩১ (প্রথম ছেলে গণিউর রাজা কর্তৃক) হাসন রাজার দ্বিতীয় রচিত বইঃ হাসন বাহার, রচনা কালঃ ১৮৭২-১৯১৪ খ্রিঃ, প্রথম প্রকাশঃ ১৯০৭ (হাসন রাজা কর্তৃক), দ্বিতীয় প্রকাশঃ ১৯২৪ খ্রিঃ, হাসন রাজার ছেলে খান বাহাদুর দওয়ান গণিউর রাজা কর্তৃক। গানের সংখ্যাঃ ৫৫৩। অনেকে অনুমান করেন হাসন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশী। জমিদারি এলাকাঃ সিলেট ও সুনামগঞ্জ উল্লেখযোগ্য পরগণা। (পরগণা= এখনকার তিন থেকে চারটি ইউনিয়নের সমান প্রায়)। লক্ষণশ্রী (বর্তমান সুনামগঞ্জ শহরে ও আশেপাশের কয়েকটি এলাকা), মহারাম, অচিন্ত-পুর, লাউড়, পাগলা, পলাশ, বেতাল, চামতলা, কৌড়িয়া, কুরুয়া ইত্যাদি পরগণা। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মতে তিনি প্রায় ৫ লক্ষ ২৭ হাজার বিঘা জুড়ে জমির অধিকারী ছিলেন। জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাঃ ১৫ বছর বয়সে হাসন রাজা উনার বড় ভাই ও বাবাকে হারান যে বছরে তাঁরা দুজনই ৪০ দিনের ব্যবধানে ইহলোক ত্যাগ করেন। সেই সময় থেকেই উনার আধ্যাত্মিক সাধনা ও চিন্তাধারার সুত্রপাত ঘটে এবং সেই সাথে মরমী গান লেখার শুরু। হাসন দর্শন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথঃ “পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাইঃ ব্যক্তি স্বরূপের সাথে সম্মন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।” স্ত্রীঃ আজিজা বানু, বোরজান বিবি, সাজেদা বানু, জোবেদা খাতুন, লবজান চৌধুরী। পুত্রঃ খান বাহাদুর দেওয়ান গণিউর রাজা চৌধুরী (১২৮৩-১৩৩৯ বাংলা), দেওয়ান হাসিনুর রাজা চৌধুরী (১২৮৫-১৩৫১ বাংলা), খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী (১২৯৬-১৩৭১ বাংলা) দেওয়ান আফতাবুর রাজা চৌধুরী (১৩০৩-১৩৬২ বাংলা) কন্যাঃ রওশন হুসেইন বানু, রওসন হাসান বানু, আলী হুসেইন বানু, রওশন আখতার বানু। মৃত্যু তারিখঃ ২২ অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বাংলা, (৬ ডিসেম্বর ১৯২২ খ্রিঃ) কবরস্থানঃ লক্ষণশ্রী, সুনামগঞ্জ (মায়ের কবরের পাশে, যে কবরখানা মৃত্যুর পুর্বেই নিজে প্রস্তুত করেন। )
তথ্য ঋণ স্বীকার:
হাছন রাজা সমগ্র: দেওয়ান তাছাউর রাজা
Comments