কিংবদন্তী সুরকার,সঙ্গীত পরিচালক,সংগীতশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখান্দের শেষ ইচ্ছা!
লাকী আখান্দ আর নেই। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টায় রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন। দুপুরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে টানা আড়াই মাস তিনি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছিলেন।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বরেণ্য এ শিল্পীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ারে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে অধ্যাপক নেজামুদ্দিন আহমেদের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত সপ্তাহে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ছয় মাসের চিকিৎসা শেষে ২০১৬ সালের ২৫ মার্চ দেশে ফেরেন তিনি। সেখানে কেমোথেরাপি নেওয়ার পর শারীরিক অবস্থার অনেকটা উন্নতি হয় তার। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় এই সংগীতকারের চিকিৎসার জন্য পাঁচ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল দেশের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষেরা।
কিংবদন্তী সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক লাকী আখন্দের দেখা একবারই পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে গায়ক অঞ্জন দত্ত। সে স্মৃতি অসাধারণ লিরিকে বন্দী করেন ভারতের বিখ্যাত এ গায়ক, সুরকার, অভিনেতা ও নির্মাতা।
১৯৯৮ সালের এপ্রিলের ঘটনা।
ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে প্রথমবার গাইতে এসেছেন অঞ্জন। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘর অডিটোরিয়ামের মঞ্চে গাইছেন তিনি। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি সময়ে এই আয়োজনের উদ্যোক্তা নিমা রহমান অঞ্জনকে জানিয়েছিলেন যে, লাকী আখন্দ আছেন দর্শক সারিতে। ব্যস, অঞ্জন মঞ্চে আমন্ত্রণ জানালেন লাকীকে।
মজার ব্যাপার হল তখন পর্যন্ত দু’জনের কেউই কারো গান শোনেননি। অঞ্জন নিছক আসর জমানোর জন্যই লাকীকে মঞ্চে আহ্বান জানালেন। এরপর শুরু হয়ে গেল যুগলবন্দী। একসঙ্গে গান গাইলেন লাকী ও অঞ্জন।
অঞ্জন দত্তের স্মৃতিতে এই অভিজ্ঞতা স্মরনীয় হয়ে থাকল এই জন্য যে, অন্য কোনো শিল্পীর সঙ্গে গাইতে গিয়ে এত উপভোগ করেননি অঞ্জন। এ নিয়েই গল্প লিখলেন অঞ্জন, গানে গানে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত অঞ্জনের ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ এ্যালবামে ‘লাকী আখন্দ’ শিরোনামের গানটি স্থান পায়।
‘লাকী আখন্দ’ স্বপ্ন দেখতেন একটি মিউজিক স্কুল করার। তিনি বিশ্বাস করেন ‘মিউজিক ফর পিস’-এ।
কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখান্দের শেষ ইচ্ছা ছিল, ‘তার গানগুলো থেকে প্রাপ্য সম্মানী এবং রয়্যালিটি যেন তার পরিবার এবং ভবিষ্যৎ বংশধরেরা নিয়মিত পান। তার গানগুলো যেন হারিয়ে না যায়, মানুষের কাছে তা সঠিকভাবে পৌঁছায়। তার গানগুলো যেন বিকৃত করা না হয়।’
আজ শুক্রবার রাতে লাকী আখান্দের এই শেষ ইচ্ছার কথা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের বলেন এরশাদুল হক টিংকু, ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী। তিনি লাকী আখান্দের পাশে ছিলেন, এই বরেণ্য সংগীতশিল্পীর জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করেছেন।
লাকী আখান্দের আরমানিটোলার বাসায় সংবাদকর্মীদের টিংকু আরও জানান, আজ শুক্রবার রাতে লাকী আখান্দের মরদেহ বারডেম হাসপাতালের শবহিমাগারে রাখা হবে। কাল শনিবার সকাল ১০টায় লাকী আখান্দের প্রথম জানাজা হবে আরমনিটোলা খেলার মাঠে।
রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখান্দকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন দেশের সংগীত, নাটক ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষজন। এখানে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাকি আখান্দের মরদেহ নেওয়া হবে আগামীকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায়। এর আগে সকাল ১০টা আরমানিটোলা খেলার মাঠে তার প্রথম জানাজা হবে। বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে লাকী আখান্দের দ্বিতীয় জানাজা হবে। দুপুরেই লাকী আখান্দকে দাফন করা হবে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সংবাদমাধ্যমের কাছে এসব তথ্য জানান লাকী আখান্দের ছোট বোন আফরোজা জেসমিন আখান্দ।
লাকী আখন্দের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে—‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘মামনিয়া, ‘বিতৃঞ্চা জীবনে আমার’, ‘কী করে বললে তুমি’ ‘লিখতে পারি না কোনও গান, ‘ভালোবেসে চলে যেও না’ প্রভৃতি।
লাকী আখান্দের সুর ও সংগীতায়োজনে উল্লেখযোগ্য অ্যালবামগুলো হলো— ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ (কুমার বিশ্বজিৎ), ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’ (সামিনা চৌধুরী), ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ (হ্যাপী আখন্দ), ‘কে বাঁশি বাজায়রে’ (হ্যাপী আখন্দ)।
‘লাকী আখন্দ’ অসুস্থতার মধ্যেও মাঝে-মধ্যে বলতেন, 'আমি সুস্থ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবো। তাকে বলবো একটি মিউজিক স্কুল করতে চাই। এটা করা অনেক দরকার।'
Comments