উল্কাপাতের কারণ এবং পৃথিবীর অন্যতম গণবিলুপ্তির কথা
বিজ্ঞানীদের ধারণা উল্কাপাতের ফলেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ডায়নোসরদের রাজত্ব। ছবি: হাফিংটন পোস্ট
সৌরজগতে বর্তমানে যে বিশাল সূর্য আর বিশাল গ্রহের উপস্থিতিতি আছে তাদের সবগুলোই ছিল মহাজাগতিক ধূলির বিস্তৃত মেঘ। মহাবিশ্বে ভাসমান হাইড্রোজেন গ্যাস, নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদিকে একত্রে বলা হয় মহাজাগতিক ধূলি। কয়েক আলোকবর্ষ ব্যাপী বিস্তৃত এরকম বিশাল ধূলির মেঘ থেকে ঘনীভূত হবার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সৌরজগতের সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ তৈরি হয়েছে।
ধূলির মেঘ থেকে জন্ম নিয়েছিল সৌরজগৎ। ছবি: পিন্টারেস্ট
কিন্তু সৌরজগতের গঠনের সময় কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল। কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গিয়েছিল। গঠন মুহূর্তে সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকতো তাহলে মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে আরেকটি গ্রহ তৈরি হতো। এক বা একাধিক কারণে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে গ্রহটি তৈরি হয়নি। তবে গ্রহ গঠন করতে না পারলেও গ্রহ তৈরির উপাদানগুলো ঠিকই রয়ে গেছে এই দুই গ্রহের কক্ষপথের মাঝখানে। মাঝে থাকা সকল গ্রহাণুকে একত্রে ‘এস্টেরয়েড বেল্ট’ বা ‘গ্রহাণুপুঞ্জ’ নামেও ডাকা হয়। এরা সবগুলো একত্র হয়ে গ্রহ গঠন করার কথা ছিল কিন্তু পারেনি সম্ভবত বৃহস্পতি গ্রহের দানবীয় আকর্ষণের কারণে। গ্রহ হিসেবে বৃহস্পতি অনেক বড় এবং এ কারণে তার আকর্ষণ শক্তিও বেশি। আকর্ষণ শক্তি বেশি হবার ফলে তা এই ক্ষুদ্র বস্তুগুলোর মাঝে এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে, এরা নিজেরা নিজেদের আকর্ষণে একত্র হতে পারেনি। ফলে বড় আকার ধারণ করতে পারেনি। আকারে বড় ও ভারী না হলে গ্রহ গঠন করাও সম্ভব নয়।
মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে গ্রহাণুর বেল্ট। ছবি: ইউটিউব
সূর্যের পরিবারে যেমন গ্রহাণু বেল্ট আছে, তেমনই শনি গ্রহে উপ-পরিবারেও বলয় বা ‘রিং’ আছে। শনি গ্রহের বলয় আছে বলেই এটি সৌরজগতের সবচেয়ে ব্যতিক্রম ও আকর্ষণীয় গ্রহ। অনেকের মতেই এটি সবচেয়ে সুন্দর গ্রহ। এই গ্রহের বলয় সৃষ্টি হবার কারণ আর গ্রহাণু বেল্ট তৈরি হবার কারণ প্রায় একই। পৃথিবীর যেমন উপগ্রহ চাঁদ আছে, তেমনই শনি গ্রহেরও অনেকগুলো উপগ্রহ আছে। উপগ্রহ তৈরির সময় কোনো একটি উপগ্রহ কোনো কারণে ঠিকভাবে গঠিত হতে পারেনি, তাই ব্যর্থ ক্ষুদ্র বস্তুগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শনির কক্ষপথে। এই বস্তুগুলোই শনির বলয়ের মূল কারণ। এমনিতে শনির মোট উপগ্রহের সংখ্যা ৬২টি, এটি সম্পন্ন হতে পারলে শনির উপগ্রহ হতো ৬৩টি।
শনির বলয়। ছবি: ওয়ান্ডারোপলিস
গ্রহাণুর এসব টুকরোগুলো সাধারণত ক্ষুদ্র আকৃতির হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কোনো কোনোটি বড়ও হয়ে থাকে। বড় হিসেবে মোটামুটি চোখে লাগে এবং অন্য কোনো গ্রহের সাথে তুলনা করা যায় এমন ধরনের বস্তুগুলোকে বলে প্লানেটিসেমাল (Planetesimal)। এদের মাঝে সবচেয়ে বড়টার আকৃতি প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার। এর নাম সেরেস। ১ হাজার কিলোমিটার পরিমাণ ব্যাসের কোনো গোলক আকৃতির বস্তুকে গ্রহের বিশালত্বের সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু এসব দলছুট বস্তুগুলোর বেশিরভাগই গোলক আকৃতির হয় না। এদের আকৃতি হয় অনিয়তাকার। চলার পথে প্রায় সময়ই এক গ্রহাণু আরেক গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মূলত পরিমাণে বেশি তো, তাই সংঘর্ষ ঘটার হারও বেশি থাকে।
এদের মাঝেই কোনো কোনোটি লাইনচ্যুত হয়ে ছুটে আসে অন্য কোনো গ্রহের পানে। অতীতে পৃথিবীর দিকেও ছুটে এসেছে প্রচুর এবং বর্তমানেও আসে অনেক। এদেরকে আমরা দেখেও থাকি। পৃথিবীর একটি চমৎকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে এর বায়ুমণ্ডল। গ্রহাণুগুলো যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে আঘাত করে তখন তার গতি থাকে অত্যন্ত বেশি। বায়ুতে সাধারণত কোনোকিছুর সংঘর্ষ হয় না, কিন্তু গ্রহাণুগুলোর গতি এত বেশি হয় যে এরা বায়ুর পরমাণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এমনকি এই সংঘর্ষে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। রাতের আকাশে যখন এই ঘটনা ঘটে তখন এই ঘটনাকে দেখতে মনে হয় কোনো তারা বুঝি নিজের অবস্থান থেকে বেরিয়ে ছুটে দৌড় দিয়েছে। আসলে ঐ সময়ে কোনো তারা ছুটে বেরিয়ে যায় না, ঐ সময়ে আসলে গ্রহাণু পুড়ে ছাই হয় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। এই ঘটনাকে সাধারণত উল্কাপাত বলে। ইংরেজিতে আরো কাব্যিকভাবে বলে Shooting Star।
উল্কাপাতের সময় মনে হয় যেন তারা খসে পড়ছে। ছবি: প্রডিজাল ফাদার
খুব দুর্লভ হলেও মাঝে মাঝে কিছু বড় আকৃতির গ্রহাণু এসে আছড়ে পড়ে। এতটাই বড় যে বায়ুর সংঘর্ষের ফলে ক্ষয়ে গিয়েও নীচে নেমে আসতে আসতে অনেকটা অবশিষ্ট থেকে যায়, পুরোটা ছাই হয়ে শেষ হয়ে যায় না। এরা এসে ভূমিতে আঘাত করে এবং এই আঘাতে ছোট বড় অনেক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন ১৯৯২ সালের ৯ অক্টোবর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে নিউ ইয়র্কের একটি গাড়িতে একটি গ্রহাণু এসে আঘাত করে। ঐ গ্রহাণুটির আকৃতি ছিল বড় ধরনের একটি ইটের সমান। এর চেয়ে বড় আকারের, একটি বড়সড় বাড়ির সমান গ্রহাণু ১৯০৮ সালে এসে আঘাত করে সাইবেরিয়াতে। সাইবেরিয়াতে এর এমন ‘ক্র্যাশ ল্যান্ডিং’-এর ফলে সেখানকার একটি জঙ্গলের বিশাল একটি এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল।
গ্রহাণুর আঘাতে পুড়ে গিয়েছিল সাইবেরিয়ার বড় একটি জঙ্গল। ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক/এপি
বিজ্ঞানীদের কাছে এমন তথ্য প্রমাণ আছে যে, প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এত বড় একটি গ্রহাণু আছড়ে পড়েছিল যার কারণে সমস্ত পৃথিবীতে দুর্যোগ নেমে এসেছিল। আমেরিকারই একটি স্থানে এটি আঘাত করেছিল এবং ধারণা করা হয় এর কারণেই পৃথিবী থেকে সকল ডায়নোসর বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এই গ্রহাণুটির আঘাতের ফলে কী পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত হয়েছিল কিংবা কী পরিমাণ ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল তার তুলনা দিতে গেলে বলতে হয়- আজকের যুগে সমস্ত বিশ্বে যতগুলো পারমাণবিক বোমা আছে তার সবগুলো যদি একসাথে বিস্ফোরিত হয় তাহলে যে পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত হবে বা ধ্বংস করবে তার থেকেও একশো গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল ঐ গ্রহাণুর আঘাত। পৃথিবীতে এখন যে পরিমাণ পারমাণবিক বোমা আছে তা দিয়ে অনায়াসেই সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলা যাবে। আর এই শক্তিকে যদি একশো গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে তো তার ধ্বংসক্ষমতার কথা কল্পনাও করা যাবে না।
এই গ্রহাণুর আঘাতের ফলে পুরো পৃথিবীতে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। সুনামি এসে আঘাত করে উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে। ভূমিকম্প সুনামি ও শকওয়েভের ফলে গাছ-পালা বন-জঙ্গল ধ্বংস হয়ে যায়। পাশাপাশি এর ফলে সৃষ্টি হয় খুব ঘন ও পুরো ধূলির আবরণ, যা সূর্যের আলোকে আটকে রাখে। এই বিশৃঙ্খল ধূলির আবরণ স্থায়ী হয় এক বছর পরিমাণ সময়, ফলে এই লম্বা সময়ে সূর্যালোকের অনুপস্থিতিতে পৃথিবীতে নরক নেমে আসে।
সূর্যালোক না থাকলে উদ্ভিদেরা নিজেদের খাদ্য তৈরি করতে পারে না, বা বাঁচে না। গাছ গাছালি না থাকলে অন্যান্য প্রাণীরাও খাবার জন্য কিছু পায় না, ফলে বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না। যারা মাংসভূক প্রাণী তারা হয়তো অন্য প্রাণী খাবে, কিন্তু অন্য প্রাণীর বেঁচে থাকতেও তো গাছ দরকার। এভাবে মাসখানেকের ভেতরেই সমস্ত পৃথিবী বিরান হয়ে যাবার কথা। এমন পরিস্থিতিতে ঐ সময়ে ডায়নোসরের সকল প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ঐ সময়ে ডায়নোসরদের পাশাপাশি অন্যান্য অনেক প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা উল্কাপাতের ফলেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ডায়নোসরদের রাজত্ব।
কিন্তু তারপরেও কিছু কিছু প্রজাতি টিকে গিয়েছিল। হয়তো তাদের ঐ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার মতো ক্ষমতা ছিল, কষ্ট করে হলেও টিকে গেছে। কিংবা তারা হয়তো লম্বা ঘুমের শীতনিদ্রায় ছিল মাটির নীচে বা বরফের নীচে, যার কারণে ভয়াবহতা তাদেরকে খুব বেশি পায়নি। এসব টিকে যাওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকেই আজকের মানুষের উৎপত্তি। ঐ সময়ে যদি কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী টিকে না থাকতো তাহলে মানুষের উৎপত্তির কোনো সম্ভাবনাই থাকতো না।
তথ্যসূত্র ১. দ্য ম্যাজিক অব রিয়্যালিটি, রিচার্ড ডকিন্স, অনুবাদ: সিরাজাম মুনির শ্রাবণ, রোদেলা প্রকাশনী, ২০১৭ ২. একটুখানি বিজ্ঞান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কাকলী প্রকাশনী ৩. গণ বিলুপ্তি: যেভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় পৃথিবীর ৯৯% প্রজাতি, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী জিরো টু ইনফিনিটি, মে ২০১৪ ৪. space.com/16105-asteroid-belt.html ৫. starchild.gsfc.nasa.gov/docs/StarChild/questions/question12.html ৬.news.nationalgeographic.com/news/2013/02/130215-russia-meteorite-meteor-asteroid-space-science-world/ ফিচার্ড ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
Comments