৩৭ বছর পর সেই মাস্টার সুমন!‘ছুটির ঘণ্টা’
ছুটির ঘন্টা ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাদেশী শিশুতোষ চলচ্চিত্র। ছবিটি পরিচালনা করেছেন আজিজুর রহমান।
পত্রিকায় আসা একটা মর্মস্পর্শী সত্য ঘটনা নিয়ে ছবিটি নির্মিত । বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহার প্রযোজনা সংস্থার নাম ছিল ‘স্বরলিপি বাণীচিত্র’। সেই প্রযোজনা সংস্থা থেকেই সত্য সাহা স্ত্রী রমলা সাহাকে প্রযোজক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন । ‘স্বরলিপি বাণীচিত্র’ থেকে যতগুলো ছবি নির্মিত হয়েছিল তার সবগুলোতেই প্রযোজক হিসেবে রমলা সাহা ছিলেন । এই ‘স্বরলিপি’ চলচ্চিত্রের নিবেদনে ১৯৮০ সালে নির্মিত হয় ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবিটি যার পরিচালক ছিলেন আজিজুর রহমান।
‘ছুটির ঘন্টা’ ছবিটি মুক্তির প্রায় ৩৭ বছর পর সেই খোকন তথা মাস্টার সুমনকে নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন নির্মাণ করলো বিশেষ অনুষ্ঠান ‘সেদিনের তারকা’। অনুষ্ঠানটি গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা করেছেন ইকবাল খন্দকার। অনুষ্ঠানে তিনি তার অভিনয় জীবনের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি কথা বলেবেন বর্তমান ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে। মাসউদুল হকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ‘সেদিনের তারকা’ প্রযোজনা করেছেন আজগর আলী। আর এটি প্রচার হবে বিটিভির বিশেষ ঈদ-অনুষ্ঠানমালায়।
ছুটির ঘন্টা ও আজিজুর রহমান ঃ
১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অসম্ভব জনপ্রিয় ও প্রশংসিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘন্টা’। যে সিনেমার কাহিনী আজও সিনেমা প্রেমীদের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবিটির পরিচালক : আজিজুর রহমান।
আজিজুর রহমান ১৯৩৯ সালের ১০ অক্টোবর সান্তাহার রেলওয়ে জংশন শহরের কলসা সাঁতাহার মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রুপচাঁন প্রামানিক। তিনি স্থানীয় আহসানুল্লাহ ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি পাস ও ঢাকা সিটি নাইট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি চারুকলা আর্ট ইনস্টিটিউটে কমার্সিয়াল আর্টে ডিপ্লোমা করেন। আজিজুর রহমান শুধু ছুটির ঘন্টার মতোই জনপ্রিয় সিনেমাই নির্মাণ করেননি, বরং ‘অশিক্ষিত’র মতো প্রশংসনিয় সিনেমাও নির্মাণ করেন। ১৯৫৮ সালে পরিচালক এহতেশামের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করা এই নির্মাতার প্রথম চলচ্চিত্র ময়মনসিংহের লোককথা নিয়ে ‘সাইফুল মূলক বদিউজ্জামান’। মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। এরপর একেএকে তিনি নির্মাণ করেন মাটির ঘর, স্বীকৃতি, অপরাধ, গরমিল, মায়ের আচঁল, জনতা এক্সপ্রেস উল্লেখযোগ্য।
‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবিটির নাম শুনেনি বা দেখেনি এমন দর্শক বাংলা চলচ্চিত্রের খুব কমই আছে। যারা মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির যে ৪/৫টি ছবির নাম বলতে পারে তাদের কাছেও এই ‘ছুটির ঘণ্টা’ নামটি থাকে। এই ছবিটির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল সেই সময়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একটি নির্মম ও বেদনাদায়ক সত্য ঘটনা চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছিল। যা সেই সত্য ঘটনাকে আরও বেশি মানুষের মনে নাড়া দিয়েছিল । আজও ছবিটির কথা উঠলে দর্শকদের মন নাড়া দিয়ে উঠে।
কাহিনী সংক্ষেপ ছুটির ঘন্টা ঃ ঢাকা শহরের নিজের বাড়ীতে একমাত্র কিশোর ছেলে খোকন (মাস্টার সুমন) কে নিয়ে মিসেস খান (সুজাতা) বসবাস করেন। খোকন ঢাকার শহরের একটি স্কুলে পড়ে। হাসিখুশি চঞ্চল ও উচ্ছল কিশোর খোকন কে স্কুলের শিক্ষক -শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীরা খুব পছন্দ করে। সেই স্কুলের দপ্তরি আব্বাস মিয়া (রাজ্জাক) ও ঝাড়ুদাড় আঙ্গুরি বেগম (শাবানা)। আব্বাস ও আঙ্গুরি বেগমের খুনসুটি সবসময় লেগে থাকে যা একসময় তাদের মধ্য প্রেমের সম্পর্কের দিকে গড়ায়। আব্বাস এর সাথে খোকনের খুব ভালো সম্পর্ক। দপ্তরী আব্বাস কিশোর খোকনকে খুব স্নেহ করে। ২দিন পরেই স্কুল ঈদের বন্ধ শুরু হবে। এই ছুটিতে খোকন মায়ের সাথে নানাবাড়ী যাবে ঈদ করতে। নানা শওকত আকবর মেয়ে ও নাতীকে নিতে স্কুলের ছুটি শুরু হওয়ার দুদিন আগেই চলে এসেছেন ঢাকায়। খোকন তার মা ও নানাভাইয়ের সাথে ঈদের কেনাকাটা করতে যায়। পথে যাদুকর জুয়েল আইচের যাদু প্রদর্শনী দেখে যাদু দেখার বায়না ধরে। মা ও নানাভাই সহ খোকন জুয়েল আইচের যাদু দেখে অবাক হয়। এভাবেই খোকনের দিনগুলো খুব ভালোই যাচ্ছিল। যেদিন স্কুলে ঈদের ছুটি ঘোষণা করা হবে সেদিন সকালে স্কুলে আসতে খোকনের মন চাইছিল না, কিন্তু খোকন মায়ের আদর ভরা কণ্ঠের আদেশ মেনে স্কুলে আসতে বাধ্য হয়।স্কুল ছুটির পর খোকন দপ্তরী আব্বাস কে নতুন কাপড় দিয়ে আব্বাস এর কাছ থেকে বিদায় নিলো। খোকন কে স্কুল থেকে নিতে গাড়ী আসতে দেরি হওয়ায় খোকন তার বন্ধু পিকলু, রবার্ট, গনেশ কে বেবি ট্যাক্সিতে তুলে বিদায় দিয়ে প্রকৃতির ডাকে স্কুলের বাথরুমে যায়। দপ্তরী আব্বাস মিয়া স্কুলের সব কক্ষ তালা মেরে চলে যাওয়ার সময় ভেতর থেকে লাগানো বাথরুমে থাকা খোকনের বাথরুমের দরজা তালা মেরে চলে যায়। খোকন বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় বুঝতে পারে সে ভেতরে আটকা পড়েছে। সেদিনের পর স্কুল আর খুলবে ১১ দিন পর। এই বাথরুমে আটকে পড়া খোকনের দিনগুলো আর খোকন কে খুঁজে না পাওয়ার অসহ্য কষ্টের দিনগুলো নিয়ে ছবিটা শেষ পর্যন্ত এগিয়ে যায়। আর তালাবন্ধ বাথরুমে ছুটি শেষ হওয়ার প্রতীক্ষার মধ্যদিয়ে হৃদয়বিদারক নানা ঘটনা ও মুক্তির কল্পনায় অমানবিক কস্ট সহ্য করার পর কিভাবে একটি নিষ্পাপ কচি মুখ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, এমনই একটি করুন দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিতে ।
ছবি মুক্তির আগে সেন্সর বোর্ড ছবির মুক্তি নিয়ে ঝামেলা করে। তাদের মতে, এই ছবি দেখলে কোমলমতি শিশুরা ভয় পাবে, তাদের উপর বাজে প্রভাব সৃষ্টি করবে।
আজিজুর রহমান বিপদে পড়লেন। তিনি একটা বুদ্ধি বের করলেন। ছবির একটা বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন, যেখানে বেশিরভাগ শিশুকে দাওয়াত করা হল তাদের বাবা মা সহ। কিন্তু ছবি শেষে দেখা গেল, শিশুরা ভয় তো পেলই না, উল্টো চোখ মুছতে মুছতে হল থেকে বের হচ্ছে, এমনকি অভিভাবকেরাও। এরপরে এই ছবির মুক্তিতে আর কোন বাধা থাকল না।
ছবির মূল ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন শিশুশিল্পী সুমন আর সাথে রাজ্জাক, শাবানা । সত্য সাহা'র সুরে এই সিনেমার বিখ্যাত গান, 'একদিন ছুটি হবে, অনেক দুরে যাব..'
মজার ঘটনা : – রাজ্জাক এই সিনেমার শুটিংএর পুরোটা সময় শুটিং সেটে লুঙ্গি পড়ে কাটিয়েছেন, ক্যারেক্টারের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য।
একনজরে ছুটির ঘন্টাঃ
রচনা ও পরিচালনাঃ আজিজুর রহমান
প্রযোজনাঃ বমলা সাহা
অভিনয়েঃ রাজ্জাক, শাবানা, সুজাতা, শওকত আকবর, খান আতাউর রহমান, সুমন, এ টি এম শামসুজ্জামান, রবিউল, শর্ব্বরী
সুরকারঃ সত্য সাহা
চিত্রগ্রহনঃ সাধন রায়
সম্পাদনঃ নুরুন নবী
ডিষ্ট্রিবিউটরঃ স্বরলিপি বানীচিত্র।
পাঠক ‘ছুটির ঘন্টা’ ছবিটি দেখুন ঃ
তথ্যসুত্র : উইকিপিডিয়া / ডাকপিয়ন২৪
Comments